হুমাইরা তাজরিন »
শুরুটা ২০০৬ সাল। একজন মা আবিষ্কার করলেন তার ছেলে সমবয়সী অন্য শিশুদের তুলনায় আলাদা, সে ঠিকভাবে কথা বলতে পারেনা। সন্তানের সুস্থ বিকাশ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন তিনি। খুঁজতে থাকেন এমন একজন শিক্ষক যিনি পিছিয়ে পড়া শিশুদের বিকশিত হতে সহায়তা করবেন। একসময় একজন শিক্ষক পেয়েও যান। কিন্তু শিক্ষিকার শিখন কৌশল তাকে হতবাক করে। তিনি দেখতে পান, তার সন্তান ছাড়াও আরো অনেক শিশুকে ঐ শিক্ষিকা টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করছেন। সে কথা তিনি ছেলের বাবার সাথে আলোচনা করেন। একদিন শ্রেণিতে ঢুকে ছেলের বাবাও দেখেন লোহার রড রাখা হয়েছে এই নিষ্পাপ শিশুদের শায়েস্তা করতে। তাদের ভ্রম ভাঙে। ডাক্তার ফাহমিদা ইসলাম চৌধুরী দম্পতি বেরিয়ে আসেন সেই বিভীষিকাময় ফাঁদ থেকে।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ফাহমিদা দম্পতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল তোফায়েল আহমেদ দম্পতিকে নিয়ে ভালো সফলতা অর্জনের স্থির লক্ষ্য নিয়ে ভাবলেন এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা যেটি হবে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক। লেফটেনেন্ট কর্নেল তোফায়েল আহমেদের নির্দেশনায় ফাহমিদা দম্পতি ছাড়াও মাহবুবুল হক খান, তাহের আহমেদ, রেহেনা রিফাত চৌধুরী, নওয়াব আসলাম হাবিব এবং অন্যরা সকলে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে একত্রিত হলেন। সিদ্ধান্ত হলো চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকই হবেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। অবশেষে ২০০৭ সালের ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি সভায় আশরাফ শামীমকে সেই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ঘোষণা করা হয়। এভাবেই আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ফাউন্ডেশন ফর অটিজম রির্সাচ এন্ড এডুকেশন ( ফেয়ার)। প্রতিষ্ঠানটির স্লোগান হলো ‘অটিজম আক্রান্তদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো’।
ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত এবং যুক্ত হতে থাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে। সংস্থাগুলো থেকে প্রতিনিধিরা নিয়মিত পরির্দশনে আসতে থাকেন এবং তারাই ফেয়ারের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফেয়ারের শিক্ষকগণ আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করেন।
২০১৭ সালে ফেয়ার ‘অটিজম উত্তরণ সম্মাননা’ অর্জন করে। বর্তমানে ফেয়ার একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থা। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর একটি জমি ফেয়ারকে ইজারা দেয়। সেখানে ফেয়ারের জন্য বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো অটিজম আক্রান্তদের জন্য হয়রানিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, ক্ষমতায়ন ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে সদস্য হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা, সহযোগিতা, শিক্ষা, সচেতনতা এবং গবেষণার ব্যবস্থা করা।
বর্তমানে ফেয়ারের রয়েছে ৭টি প্রোগ্রাম। সেগুলো হলো স্পেক্ট্রা স্কুল, আর্লি ইন্টারভেশন, টেকনিক্যাল আইটি হাব, টুইনিং উইথ মেনিস্ট্রাইম স্কুল, জব রিডিংনেস প্রোগ্রাম, কমিউনিটি পার্টিসিপেশন এবং রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
এছাড়া ফেয়ারের প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো হলো : বেকারি, রান্না করা ,বাজার/ কেনাকাটা করা, কাগজের জিনিসপত্র বানানো, কার্পেট স্লিপার বানানো, কাপড়ের উপর ব্লকের ডিজাইন করা, কাপড়ের উপর স্ক্রিনপ্রিন্ট করা, পাথর এবং পুতির গহনা তৈরি করা, সেলাই করা, কার ধোয়া, শারীরিক প্রশিক্ষণ ও খেলাধুলা, অফিসের কাজে সহযোগিতা, কম্পিউটার পরিচালনা এবং গ্রাফিকস প্রশিক্ষণ, সাধারণ জ্ঞান এন্ড শিক্ষা, গান ,নাচ, আঁকা এবং অভিনয়ের প্রশিক্ষণ, অকুপেশনাল থেরাপি, প্লেথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, ব্রেইন জিম, নেরেটিভ থেরাপি, শাকসবজি ,মাছ, মুরগির খামার করা, বাণিজ্যিক বাগান তৈরি করা।
ফেয়ারের সূচনালগ্ন থেকে সাথে ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম। তিনি বলেন, ‘আগে অটিজম আক্রান্তদের সংখ্যা কম ছিলো। কিন্তু এখন সংখ্যা বেড়েছে। কারণ এখন শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। যাদের সন্তানেরা এই অটিজমে আক্রান্ত হয় তারা নানাভাবে ভোগান্তি এবং হয়রানির শিকার হয়। তারা বাসা ভাড়া নিতেও কষ্ট পায়। এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান এখন রয়েছে। তবে অনেকে এর মাধ্যমে ব্যবসা করছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো হতে হবে নন প্রফিটেবল।