জাহিদ হাসান হৃদয়, আনোয়ারা »
সুন্দর মন জুড়ানো লেক, আর গাছগাছালিতে ভরা চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড়। কালের বিবর্তনে শিল্পায়নের ফলে দেয়াঙ পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুখ থুবড়ে পড়লেও এখনো পাহাড় ঘিরে অনেক সৌন্দর্য লেপ্টে আছে। একসময় বাঘ, ভাল্লুক, নানান প্রকারের হরিণ এবং হাতির বসবাস থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে বন্যপ্রাণী শূন্য থাকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলীর ঐতিহ্যভা-ার দেয়াঙ পাহাড়। তবে গত বছর দশেক ধরে দেয়াঙ পাহাড়ে আবারও হাতির আনাগোনা শুরু হয়। এরই মধ্যে বছর পাঁচেক আগে থেকে দেয়াঙ পাহাড়ে বাস শুরু করে একটি হাতির দল। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে হাতির দলটি খাদ্যের খোঁজে কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান, দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার ওয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে বিচরণ করে।
স্থানীয়রা জানান, দেয়াঙ পাহাড়ের কেইপিজেড এলাকা থেকে পানির টাঙ্কি এবং মুহাম্মদপুর এলাকা আশপাশের জায়গা দিয়ে বর্তমানে টানেল অ্যাপ্রোচ সড়ক দিয়ে বটতলী, হাজিগাঁও এলাকার পাহাড় এবং ফসলি জমিতে বিচরণ করতো। এখনো বিভিন্ন সময় হাতিগুলো টানেল সড়ক পার হয়ে এসব এলাকায় বিচরণ করে। তবে টানেল উদ্বোধনের পর যান চলাচল শুরু হওয়ায় এই এলাকা দিয়ে হাতির যাতায়াত অনেকটা কমেছে। হাতির পারাপারের সময় দ্রুত গতির যান চলাচল বিপজ্জনক হতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা।
সরেজমিনে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তের সাড়ে তিন কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়কে দেখা যায় দক্ষিণ বন্দর সড়কটিতে কান্তির হাট এলাকায়, খোলালপাড়া এলাকায় এবং মুহাম্মদপুর এলাকায় মানুষ এবং যান চলাচলের জন্য তিনটি আন্ডারপাস করা হয়েছে তবে যে সমস্ত পথ দিয়ে হাতি চলাচল করে সে সমস্ত পথে কোনো এলিফ্যান্টপাস বা রুট করা হয়নি। এভাবে হাতি চলাচলের পথ বন্ধ করলে হাতিগুলো খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে হামলা করতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, সর্বশেষ ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ৭টার দিকে বন্যহাতির পাল কেইপিজেড সংশ্লিষ্ট এলাকা ১ নম্বর বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চক এলাকার মোহাম্মদ উল্লাহ পাড়ার মো. আব্দুলের বাড়িতে তা-ব চালিয়ে ঘরের দেওয়াল ও আসবাবপত্রের ক্ষয়ক্ষতি করে। এরপর ১৪ নভেম্বর একই এলাকার জয়নাব বেগমের ধানক্ষেত নষ্ট করে। এর আগে গত ৫ বছরে তিনশতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কর্ণফুলী ও আনোযারার অন্তত ১৭ জন, আহত হয়েছেন প্রায় ৫০-৭০ জন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে হাতির আক্রমণে নিহত হয়েছে ৫ জন। তাদেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা, আহত হয়েছেন একজন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ টাকা এবং ৩৩ জন মানুষের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ৭ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছরেও নিহত হয়েছে ৫ জন। তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা, আহত হয়েছেন ৫ জন। তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা এবং ৫৮ জনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ১২ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা।
চট্টগ্রামের ইতিহাসবিদ জামাল উদ্দিন জানান, কর্ণফুলী উপজেলার শাহমীরপুর এলাকাকে আনোয়ারার বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এর মাজারের দক্ষিণ পার্শ্ব পর্যন্ত দেয়াঙ পাহাড়। ব্রিটিশ আমলেও এই দেয়াঙ পাহাড়ে বাঘ, ভাল্লুক, শৃগাল, নানান রকমের হরিণ এবং হাতির বসবাস ছিলো। আনোয়ারায় ‘বাঘমারার চর’ নামের একটা জায়গা আছে, জানা যায় ওখানে বাঘ মারা হতো। কিছু বছর আগেও হরিণ দেখা যেত দেয়াঙ পাহাড়ে যা মানুষের অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাঝখানে পাহাড় নিধন বনায়ন ধ্বংস করার কারণে হাতিগুলো বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় পরবর্তীতে কিছু বছর আগ থেকে হাতিগুলো তাদের পুরানো বাসস্থান দেয়াঙ পাহাড়ে আসা-যাওয়ার একপর্যায়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। হাতিরা খাবারের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করে। আমরা যদি হাতিগুলোকে বিরক্ত করি, চলাচলে বাধা সৃষ্টি করি তাহলে হাতগুলো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে মানুষের ক্ষতিসাধন করবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সাংবিধানিক আইন। সুতরাং বড় ধরনের প্রকল্প নেওয়ার আগে জীববৈচিত্র্যে কোনো ধরনের সমস্যা হবে কি-না এই বিষয়ে স্টাডি করা উচিত। যদি সমস্যা হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায় তাহলে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব না ফেলে এটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। হাতির বিচরণের ক্ষেত্রে আন্ডারপাস, ওভারপাস যেগুলোকে এলিফ্যান্টপাস বলা হয়- এগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। তবে টানেলের ক্ষেত্রে বিষয়টি তাদের মাথায় ছিলো না। এটি না থাকার কারণে হাতি তাদের বাসস্থান হামলা এবং ফসলের ক্ষতি করতে পারে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, হাতি এমন একটা প্রাণী, তারা যে জায়গায় বিচরণ করে সে জায়গায় ১২ বছর ধরে বিচরণ করতে থাকে। আনোয়ারা এলাকায় একসময় হাতির অভয়ারণ্য ছিলো যেখানে আমরা লোকালয় করেছি। স্বাভাবিকভাবে হাতগুলোকে অন্যত্র সরানো সম্ভব না। বনাঞ্চল কিংবা হাতি চলাচলের পাশে রাস্তা করা হলে স্বাভাবিকভাবে হাতি চলাচলে বিঘœতা ঘটবেই। তারা হয়তে স্বাভাবিকভাবে অন্য আরেকটি চলাচলের রাস্তা করে নেবে। কোনো জায়গায় হাতি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলে তাদের পথ পরিবর্তনের বিষয়ে কাজ করি আমরা।