রফিক উদ্দিন বাবুল, উখিয়া :
উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের পাহাড়ে ছিল হাতির আবাসস্থল। সেখান থেকে মিয়ানমার এবং মিয়ানমার থেকে পাহাড়িপথ বেয়ে এসব হাতি বালুখালী টিভি টাওয়ার এলাকা দিয়ে মধুরছড়া ও দোছরী বনাঞ্চলে আসা-যাওয়া করতো। এ সময় বন্যহাতির দল বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দিয়ে আম-কাঠাঁল ও ধানসহ বিভিন্ন ফলজদ্রব্য খেয়ে ফেলত। হাতির জ¦ালায় অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামবাসী আতশবাজি ফাটিয়ে হাতির দলকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতো। বন্যহাতি লোকালয়ে এসে কৃষক পরিবারগুলোর ক্ষয়ক্ষতি করলেও তারা মানুষের প্রাণসংহার হয়, এমন কাজ করতো না বলে গ্রামবাসীর হাতির দল নিয়ে তেমন ভয়ভীতি ছিল না। কথাগুলো বললেন রাজাপালং ইউনিয়নের দোছরী গ্রামের সমাজসেবক সৈয়দ হামজা। তিনি জানান, হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের রাস্তা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের দখলে চলে যাওয়ার কারণে বন্যপ্রাণীসহ হাতির পাল এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। অস্থিত্ব সংকটে পড়ে এসব প্রাণী এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীতি হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এদেশে আশ্রয় নেবার পর বনসম্পদ নষ্ট করে গভীর অরণ্যে যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকুল বসবাস করে আসছিল, সেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। মধুরছড়া গ্রামের শামশুল আলম জানান, রোহিঙ্গারা নির্বিচারে গাছগাছালি সাবাড় করে সেখানে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার কারণে বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। দিনে-রাতে লোকালয়ে খাদ্যসন্ধানে হানা দিতে গিয়ে ঘরবাড়ি-ফসল, এমনকি বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। এসব ঘটনায় গ্রামবাসাীর আক্রমণে বেশ কয়েকটি হাতিও মারা গেছে। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, বন্যহাতির আক্রমণে গত তিন বছরে উখিয়ায় শিশুসহ ১৩জন, রোহিঙ্গাসহ ২২ জন মারা গেছে। তবে বন্যহাতি কয়টি মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি কেউ। এ অবস্থায় বনের হাতি বনে রাখতে সরকার কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের আওতায় আলাদাভাবে ৩১০ একর ‘প্রোটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর বনায়ন’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৬ হাজার ১৬৪ একর জায়গায় বসতি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। এর ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন দাতাসংস্থার অফিসও রয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জ্বালানির প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ১ হাজার ৮৩৭ একর বনের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৮ হাজার ১ একর পাহাড়, বন-জঙ্গল ধ্বংস করে তাদের দখলে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। তার মধ্যে উখিয়ার বুনোহাতির করিডোর ও আবাসস্থলও রয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই বুনোহাতির মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ইতোমধ্যে ১৮৫ একর আয়তনের এলাকায় ‘প্রোটেক্টেড করিডর’ গড়ে তোলার কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ১২৫ একরের কাজ চলছে, যা আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। এসব বনায়নে বন্যপ্রাণীর খাদ্য হিসেবে জারুল, তেলশুর, চাপালিশ, বট, কলা, কাঁঠাল, ঢাকিজাম, পুতিজাম, কালোজাম, গর্জন, বর্তা, কদম, বৈলামসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুখাদ্য সংশ্লিষ্ট গাছ অন্তর্ভুক্ত থাকবে জানিয়েছেন উখিয়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী তরিকুল ইসলাম।
এ বিষয়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, ‘হাতিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় ‘প্রোটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর’ নামে বনায়নের কাজ চলছে। পাঁচবছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই অঞ্চলে বন্যহাতির আবাস ও খাবারের অভাব হবে না। বুনোহাতিও আর খাবারের সন্ধানে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না এবং এর মাধ্যমে প্রাণীগুলো রক্ষা পাবে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিত সেন বলেন, ‘কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করা হাতির খাদ্য এবং আবাসস্থল বিপন্ন, তাই হাতিরা খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসছে। হাতির নিরাপদ আবাসস্থল এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ওই এলাকার হাতি ও বন্যপ্রাণীর জীবন বিপন্ন হবে।’
রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ জালাল আহমদ বলেন, ‘আমরা যারা পাহাড়ি এলাকায় হাতির আবাসস্থলে ঘর করেছি, তারা বাধ্য হয়েই এখানে থাকছি। প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা বসতিরা হাতির ভয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাসে বন্যহাতি এখানে হানা দেয়। গত কয়েকদিন আগেও একটি হাতি ক্যাম্পে এসে বেশ কয়েকটি ঝুপড়ি ভেঙে ফেলেছে। এখানে রাত হলে রোহিঙ্গাদের হাতি আতংক নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। অন্য কোথাও জায়গা পেলে রোহিঙ্গারা সেখানে চলে যাবে।