সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতায় মহাকালের মুক্তি

মো. আরিফুল হাসান »

এক অলিখিত জ্যোৎস্নায়, আমরা বলেছিলাম পরস্পরকে ভালোবাসতে। বলেছিলাম ঘুম ও নূপুরে, আমাদের সমতালিক মৃদঙ্গ বাজে। বাজে ভৈরবী রাগে, আমাদের মাতাল জ্যোৎস্নায়, এমন আপেক্ষিক বাগে। বলতে পারেন, পিয়াসীর ঘুমচোখ কিনা? কিংবা বলতে পারেন মাতাল ভ্রমর। অথবা যে অগ্রজ ছায়া ফেলেছিলেন দুধে-  জ্যোৎস্নায়,  নাগরিক কাহনে-কাহনে, যাপনের সবগুলো পথ যিনি অবিরল আহ্বান করে গেছেন নিকুঞ্জরথে, ঠিক তেমনই আরেক ফাগুনে আমাদের বাগানবিলাস এমনি-এমনি ফুটবে, পথিকের পায়ের চিহ্নে ছায়া ফেলে। যে বসন্ত চলে গেছে, অথবা আগত যে বসন্ত; সবগুলো তখন কেমন ফুলে-ফুলে প্রতিভাত হবে জাগরুক হৃদয়ের মাঝে। তখন একজন সৈয়দ শামসুল হক মশাল ধরে এগিয়ে থাকবেন বাঁক থেকে বাঁকে।

অতলান্ত সাগরের মাঝে একজন নাবিক যতটা মীনচারী, কিংবা আকাশের মেঘে-মেঘে পাখিরা যতটা স্বাধীন, তার চেয়ে আরও বেশি অবমুক্ত, আরও বেশি বস্তুনিষ্ঠতায় সৈয়দ হকের কবিতায় ভেসে যেতে পারবে সময়ের ভ্রমর। সংক্ষেপিত সূত্রে, কিংবা অবিরল স্রোতের ব্যাকরণে আরও-আরও গভীর, আরও-আরও সুন্দরের জনক একেকটি পঙক্তি ঠিক যেন ইতিহাস, কিংবা কোনো সভ্যতার ভূমিচিহ্ন। প্রবাল থেকে পারস্য সাগরে, নিম থেকে নিশিন্দার ফুলে-ফুলে অলিত খন গুনগুনিয়ে ওঠে, এ জীবন, হায় এ জীবন! বৈভব ব্যাকরণে তখন সৈয়দ হক পসরা নিয়ে হাজির হন :

‘সে কারো প্রিয়তম নয়।

পবিত্রভূমি মানুষের সন্তানের সাধ, উদ্যম,

আর খাদ্য মানুষের,

পশুর, এমনকি কুটিল কিন্তু মোহিনী….

জ্বলজ্বলে তারা যখন দিকটীকা দেখায় তখন মরুতে কিংবা পর্বতে, সমতলে কিংবা বিশ্বায়নের উষ্ণতা যুগে, সব বয়েসেই, সব দেশেই কি প্রসঙ্গ এঁকে দিলেন এক অলৌকিক জলছবির নির্মাতা হাত। জাদুকর, ফুলের সুবাসভরে বুকে নেয়, সাহসটা উপচে ওঠে কৃষ্ণচূড়ার রঙে। সমস্ত অস্থিরতা বুকে তখন গুমরে কাঁদে ঢেউ আর লণ্ঠনবাহীদের উদ্দেশ্যে কাপ্তেনের কণ্ঠ :

‘লণ্ঠনে তার রঙ্গীন আলো পড়ে

নকশা করা দেয়ালপুটে আর

শামিয়ানার চিত্রাবলি জুড়ে

নিয়তি আর রাজার সমাচার …

প্রদীপ্ত মুখাবয়ব, অরণ্যে পাখিদের সুর, ঝিরিঝিরি ঝরনার গান, ঘুমভাঙা প্রথম সকাল যখন আমাদের সামনে আসে। কিংবা ধরা যাক আমাদের চোখ থেকে আলো সরে গেলে যে অন্ধকার গ্রাস করে কিংবা যখন স্বপ্নে হারাই পথ, একাকী অন্ধকারে কেঁদে মরি। মাফিয়ার মতো করপোরেট পৃথিবী চেপে ধরে তৃতীয়বিশ্বের টুঁটি, বিশেষ কারণে তখন সৈয়দ হক ভরসা হয়ে দাঁড়ান :

‘বর্ষার ফলকে এক অশুভ বিশাল কালোপাখি

বিঁধে নিয়ে স্থির আছে সুতোর বুনোনে,

অনুজ্জ্বল বর্ণে আঁকা রাণীÑ

বলেছে যে অন্ধকারে গাঢ় তীব্র চুম্বনের পর

আমার হৃদয় ওই পাখিটির ডানা …

এ এমন এক গন্তব্য যা শুধু পথিককেই উৎসাহিত করে নিজের মাংশ নিজে খেতে। এ এমন এক গন্তব্য যা কেবল পায়ে-পায়ে পথ ভুলিয়ে দেয়, আর বিভ্রমের ভেতর থেকে একটি পরিপূর্ণ বর্ণনার স্বাদ মুসাফিরের ধূসরিত বর্ণমালায় বেজে ওঠে। তখন জোনাকি অথবা জাজ্বল্য তারা, তখন নষ্টচাঁদ অথবা বাঁকা হরফের বৈরাগ্য সবকিছু কেমন সৈয়দ হক-সৈয়দ হক মনে হয় :

‘সিঁড়ি দিয়ে নামছো তুমি তখন থেকে,

তোমার দু’হাতভরে আমার চোখের ছায়া

পাঠিয়ে দিয়েছি,

যতবার ধুলো থেকে নিয়েছি গোলাপ

ততবার তা পড়ে গেছে …

ভালোবাসার সমীকরণে, দুটো উজ্বল দুপুর, চিলের ডানায় মেলে রোদ, একটি আকাশকে ফালা-ফালা করে কেটে ফেললে দেখা যায় তানপুরার কোরাস, মৃদঙ্গ করতালে, খেয়ালের ভুলে এক অমানিশা ঘোর এঁকে দিলে প্রান্তর জুড়ে। তৃষা ও তমসা, দুপুর ও দৃশ্যান্তর উদ্যানে তখন বেখবর হয়ে পড়ে থাকে, ‘এক বিহঙ্গ ছুরির মতো ও আকাশে বিদ্ধ হতে চায়।’ আবার যখন বিকেলের শান্ত জলস্বরে খুনসুটির বাদামের খোসা উপচানো ছবির হাটের কোলাহল, ফুল তুলতে তখন ফল্গুধারার মতো ছুটে ক্ষুধা, নাগরিক বিম্বিসার গতি :

‘প্রাচীন পাতার হাত সে

বৃক্ষের আকাশের নীল দেখে উল্লসিত,

উড়ে কোটি চিল, বলেÑ

মৃত্যু এক অনুপম ফুল, মৃত্যু তার হয় না

কখনো, সময় করে না তার সুগন্ধহরণ …

কাঁপতে থাকে বিকেল, কাঁপতে থাকে পাতা। অবশিষ্ট আলো শেষনিশ্বাস ফেলে দূরে চলে গেলে সন্ধারাতের মতো জুজু এসে ভিড় করে চোখের চশমায়। শোকের আকুল দরিয়া ফেনায়িত হয় জোয়ারের টানে। নিশ্বাসে তখন বিশ্বাস ও ভালোবাসার বীজ বিকিরণ ছড়াতে থাকে।

‘যেন চিড় ধরেছে শূন্যের দর্পণ অন্ধকারে

(তোমাতেই আদি ও অন্ত)

আর উপচে পড়ছে তার এতকাল

সঞ্চিত সহস্র মুখ …

সুখ-দুঃখের পারাপারে কেউ তার হাল ছেড়ে বসে থাকে। জায়নামাজে সন্ধ্যাকাশ আরও বেশি মর্মময় হয়ে ওঠে। প্রণত চিন্তায় তখন ঘুরপাক খায় এক পশলা মেঘের বেহারা :

‘কি আছে সন্দেহ তাতে? জানি সেই

দ-ে ভাঙে সব অনুক্রম,

মিলায় সিঁড়ির শাদা আপতিক রেখা,

বিষম ঘুর্ণির হাতে নাজেহাল তাড়িত হৃদয়

নাচে একতাল একবৃত্তে মরণের ধ্বনি ওঠে

ফেনায়-ফেনায়, বর্তুল প্রোথিত করে

ঋদ্ধি বৃদ্ধি সংরাগের সহাস্য নিনাদে,

মৃত্যুকে জীবন দেয়, জীবনের মৃত্যুকে ভোলায়;

কি কান্তি! তোমার তনু এ-হৃদয় আসন্ন সন্ধ্যার

পটে নাচায় নিয়ন।’

‘গত রাতে বানানো নৌকো

পৌঁছে গেছে ত্রিপূর্ণির ঘাটে।’

অথচ মল্লারা সব ঘুমেই করলো অপচয় আর অনিষ্ট চিন্তায় একটি রাত তারাদের সাথে জেগে থেকে-থেকে সর্বাংশে ক্ষয় করেছে তার অস্তিত্ব। তখন পেলব মাংশের দেশে, দুর্দ- হরফে একজন সৈয়দ শামসুল              হক জানালার পর্দা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেখালেন প্রস্ফুটিত ভোর, দেখালেন আলোর নাচন। আমরা আমাদের অজ্ঞতার জন্য অনুকম্পা আশ্রয় করলাম আর লণ্ঠনের আলো জ্বলতে থাকলো নতুন কোনো সংবিধানের পাতাভাষ্যে। শীর্ষটীকায় আমরা দেখলাম :

‘অথচ নদীর শব্দ নয়, গ্রাম থেকে উৎসবের ডাক নয়, নাকি দমকানো বাতাসে দরোজা? ¬তাহলে

কি সে খুললো চোখ? একবার বেজে উঠলো ঢাক;

যখন শুনতে পেলাম, তখন আর শোনা গেল না। স্বস্তিহীনতায় অনবরত পাশ ফিরতে লাগল

আমাদের এ-ও-সকলে। …

মহাকালের স্বরলিপি লেখে এক বিনিদ্র যাযাবর। চোখ তার মুছে গেছে কুয়াশার নীলে। বিবর্ণ ফসিল থেকে ধোঁয়ায়িত কফির পেয়ালা, সব কেমন উচ্চারিত হয়, সত্যের নিভৃত ভাষণে। তৎপর আদিমতম ঘ্রাণ, ইন্দ্রিয়ের দরোজায় একা, কড়া নাড়ে, কড়া নাড়ে বিষাদের আঙুল; নবীন জলচিত্রের রঙের অক্ষরে :

‘খ-িত মৃত্যুর মতো ঘুম হয় রাতে।

কোনো-কোনো রাতে অকস্মাৎ জেগে ওঠে

ঘুমের মরুতে সেই প্রস্তর-ফলক …

আবার অনেক অখ-তার ভেতর, একপশলা ধোঁয়া যেমন পাক খেতে-খেতে ওঠে গিয়ে মিলিয়ে যায়; বিকল্প বরফে তেমন আবৃত করে শীতের রাত্তির। কিন্তু যে অরণ্যে পথহারা একা, তারও কিছু কুর্নিশ থাকে, চপলের পথে :

‘নিরালোকে আছড়ায় বাঘ। অতঃপর

বিয়ারের মাত্রা চড়ে। বই হয় বিজ্ঞ

পেঙ্গুয়িন। নিঃসঙ্গ গীর্জায় হাঁটু গেড়ে

প্রার্থনায় টি.এস. বসেন। নাজারীয়

যুবক অধুনা বারে বিক্রী করে সুরা,

ভগ্ন থামে দেয়ালে চিত্রিত।’

ছায়াহরিণীর ক্ষুরের চিহ্ন পাওয়া যায়। কালপুরুষের কথামালা জমিনের বুকে ফসলের উৎসব লেখে। তাবৎ আসরের শ্রোতা চুপ করে থাকে। যেন কোনো ঝড়ের বাহক, এখনই নামবে ঘূর্ণি। যেন কোনো সংকেত সংরাগের, এখনই একতারা হাতে নেমে পড়বে অন্যলোকে লালন। রবীন্দ্রনাথের শীতস্পর্শী সুরের কোলাজে, স্বর্ণের ঘোমটা খোলে বধূ দেখলো তার নাকছাবিটি খোয়া গেছে। তখন জলের অতল থেকে সৈয়দ হক ভেসে ওঠেন পাফিনের কারুকার্য ঠোঁটে :

‘এখন ধীরে ধীরে বাড়িটার চোখে জলের

ফুল ধরেছে একটি-দুটি করে

এখন তার দেহে পুঞ্জ-পুঞ্জ শেওলা রেখে যাচ্ছে

দিগন্তের নীল ঠোঁট

কড়া নাড়লে মাথায় গুলির গর্ত থেকে

অন্ধকার টসটস করে পড়ছে …

অঘ্রাণের মাঠে-মাঠে শেষ হয় আলোর উৎসব। নর্তকী  দেহে মেদ জমে। কুয়াশার ভেতর থেকে কোনো কবি নিয়ে আসে কালের খোলস। গুহার অন্ধকারে মেতে ওঠে অভিযাত্রী দল। নীলজলে চাঁদ হাসে। সরোবরে খেলা করে মেঘের রাজহাঁস।

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় ফুটে ওঠে মহাকালের মুক্তি।