আবুল কালাম বেলাল :
শিশুসাহিত্যে অনিবার্য একটি নাম সুজন বড়–য়া। পরিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল লেখক তিনি। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। তাঁর কলম যেন ঝরনাধারা। কি ছড়া, কি গল্প, উপন্যাস-নাটক-জীবনী-প্রবন্ধ-নিবন্ধ সবক্ষেত্রে তাঁর কলম সমান সরব। তবে তাঁর প্রধান চর্চিত মাধ্যম কিশোর কবিতা। প্রকাশিত ২৫টি কাব্যগ্রন্থ তার প্রামাণ্য স্মারক। কিশোর কবিতাতেই তার যত ব্যুৎপত্তি। পাঠকপ্রিয়তাও ঈর্ষনীয়। তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের প্রভাবে অনেকে আজ কবিতামুখী। তাঁর প্রতিটি কবিতাই সুখপাঠ্য। শিশু-কিশোরদের জন্য সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা। তার মধ্যে একটি ‘মাগো আমি যুদ্ধে যাবো’।
কোথায় আমার ঢাল তলোয়ার, কোথায় ধনুক-তীর?
মাগো আমি যুদ্ধে যাবো, সাজবো তিতুমীর।
যুদ্ধে গেলে ভয় কী তোমার, ভয় কী বলো মা?
আমার সকল বোন তোমাকে দিচ্ছে পাহারা,
তোমার যত দুঃখগাথা, তোমার চোখের জল
আমার বদল ওরাই দেবে মুছিয়ে অবিরল।
তোমার গলার নীলমণিহার ছিনিয়ে নিলে কেউ
তুমি কি মা বুকের মাঝে তুলবে শোকের ঢেউ?
তোমার মেয়ে মেঘনা আছে, ভাবনা কেন আর?
সাগর থেকে মুক্তো এনে বানিয়ে দেবে হার।
তোমার কানের দুল কখনো হারিয়ে যদি যায়,
লক্ষ্মী মাগো, তুমি কি চোখ ভাসাবে কান্নায়?
না মাগো না, তোমার পাশে ফুটবে যখন ফুল,
স্বর্ণ-মেয়ে কর্ণফুলী গড়বে ফুলের দুল।
তোমার আঁচল উড়িয়ে নিলে কালবোশেখি ঝড়,
ভেবো না মা-এই পৃথিবীর সবাই তোমার পর।
পদ্মা আছে, নতুন শাড়ি কিনতে যদি হয়-
ইলিশ নামের গয়না দেবে শাড়ির বিনিময়।
আমার দেবার কী আছে মা! যুদ্ধে দেবো প্রাণ,
আর দেবো সব বোনের গলায় তোমার জয়ের গান
গানের সুরে ঘুমিয়ে যেয়ো, গড়িয়ে যাবে রাত,
বোনরা তোমার ঘুম ভাঙাবে বুলিয়ে নরম হাত।
হাজার নদীর মাতা তুমি, নদীর কাছে যাও
আমি এবার যুদ্ধে যাবো, মাগো বিদায় দাও।
এটি একটি স্বদেশপ্রেমের কবিতা। এতে প্রতিফলিত হয়েছে দেশমাতৃকার প্রতি গভীর মমতা। দেশের প্রতি দায়বোধ, দেশের জন্য কিশোরের আত্মউৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতি। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছে এদেশ ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রাণী সে যে-আমার জন্মভূমি।’ আর শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া সেই ‘সকল দেশের সেরা জন্মভূমি’কে রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়াই করার শপথ করে বলেন, ‘আমার দেবার কী আছে মা! যুদ্ধে দেবো প্রাণ’। এই যে দেশের প্রতি ভালোবাসা, এই যে কিশোরের দায়বোধ, তা অসামান্য, অপূর্ব। এ পঙক্তিটিই কবিতার মূল প্রাণ। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে যে কেউ পারে না। দেশের জন্য আত্মনিবেদন করতে হলে চাই দেশের প্রতি অঙ্গীকার, গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। প্রত্যেক কিশোরকেই এ বক্তব্য আন্দোলিত করে, উজ্জ্বীবিত করে। কবিতাটি কেবল কিশোরপাঠ্য নয়, সব শ্রেণির পাঠক এর রস আস্বাদন করতে সক্ষম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ কারাবন্দি হওয়ার আগে বাঙালি জাতিকে বলেছিলেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে রক্ষা করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।’ বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে দেশকে স্বাধীন করেন। সেই যুদ্ধ এখনও চলছে নানামাত্রিক ইস্যুতে। তার আবেদন-আবেশ যেন কবিদেরও ছুঁয়ে গেছে। তারাও কলম হাতে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। তারা কিশোরদের মাঝে সেই যুদ্ধের অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে চান। সুজন বড়–য়ার এ কবিতাই তার অন্যতম স্বাক্ষর। বীর মুক্তিযোদ্ধারা সুজলা-সুফলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে টইটম্বুর এদেশের স্বাধীনতাকে বাঙালিদের উপহার দিয়েছেন আর সেই বাঙালি কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ও দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারবে না? অবশ্যই নিতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে। সেই অমর কথাগুলোই কবি উক্ত কবিতায় বাক্সময় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মহৎ রশ্মি বিকিরিত এ কবিতা কিশোরদের দেশরক্ষার চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করবে। দেশমায়ের প্রতি, নদীমাতৃক দেশের প্রতি আস্থাশীল এবং দেশদরদি হতে উৎসুক করবে। কবিতানির্মাণের মুনশিয়ানায়ও আমরা চমকিত হই। কবিতার নায়ক যুদ্ধে যাওয়ার অভিপ্রায়ে তিতুমীর সাজতে চায়। তাই ঢাল-তলোয়ার ধনুক-তীর খুঁজছে। একদম যৌক্তিক ও সমার্থক উপস্থাপনা। কেননা তৎকালে (তিতুমীর-এর আমলে) অস্ত্র, বোমা, গোলাবারুদ ছিল না। সমরাস্ত্র বলতে সেই ঢাল-তলোয়ার, ধনুক-তীর। যদি কবি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর সাজার কথা বলতেন তবে তা হত বেখাপ্পা এবং অযৌক্তিক। এখানেই কবির চিন্তাশক্তির প্রবল প্রকাশ ও দক্ষতা। গুরুত্বানুগ শব্দচয়ন ও যথোপযুক্ত উপমা প্রয়োগের ফলে সহজেই ভাবকে বহন করে নিয়েছে কবিতাটি। মমতাময়ী মা’র মতো নদীর সুধাছবি ও সুরব্যঞ্জনার সাক্ষাৎ পাই অপূর্ব মুগ্ধতায়। চিরাচরিত আঙ্গিকে আশ্চর্যরকম সহজ-সরলরূপে রচিত এ কবিতা যে কেউ কণ্ঠস্থ করতে পারে নিমিষেই। কবিতায় যে সব নদী উঠে এসেছে এবং স্বতন্ত্র স্বরে স্বতন্ত্র বাক-প্রতিমায় বিম্বিত হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই। অনুপ্রাসের দ্যোতনা, যৌক্তিক ভাবনা, সর্বোপরি, দেশমাতৃকার প্রতি বীর কিশোরের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা অসাধারণ। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের দেশমাতৃকার প্রতি উজ্জীবিত করতে এ ধরনের কবিতা পাঠ্যভুক্ত হওয়া দরকার। বিখ্যাত কবি টিএস এলিয়ট বলেছেন ‘বোঝার আগেই কবিতা আমাদের কাছে পৌঁছে যায়।’। ছন্দ কবিতার ভাষাকে যেমন শ্রুতিমধুর করে তোলে তেমনি কবির ভাবকে পাঠকের কাছে করে তোলে হৃদয়গ্রাহী। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ^াস করি, কবিতাটি চিরায়ত কবিতা হিসেবে পরিগণিত হবে। সুজন বড়–য়া আরেকটি অনন্য কিশোর কবিতা ‘কৃষ্ণচূড়ার কাছে’।
কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে, কে?
মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে,
আলতারঙে এমন যদি সাজবেই বার বার,
তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর?
লাল পরাগে ডাল রাঙিয়ে; রাঙিয়ে নিজের মুখ,
আমার মাকে কাঁদিয়ে তোমার কেমন বলো সুখ,
কি সুখ বলো মায়ের মনে ঝলকে তুলে আজ?
ভাইহারানো বোনহারানো আগুনছবির ভাঁজ।
নিজ্ঝুম এক রাতের বেলা মা দিয়েছেন ঘুম,
দাদার চোখে আলোর ধাঁধা, ঘুম দিলো না চুম,
মাকে রেখে তখন আমার দাদা সূর্য সেন-
পুব আকাশে উঠবে বলে পশ্চিমে ডুবলেন।
প্রীতিলতা নাম শুনেছো? সে যে আমার বোন,
রঙ-তুলিতে দেশ আঁকতো, আঁকতো ঘর উঠোন,
এঁকেই তুলি ক্ষয় করেছে, জয় করেছে ভয়,
প্রীতিলতার সেসব স্মৃতি পরম প্রীতিময়।
ভাইয়ের কথা বলবো আরো, শুনবে কি তারপর?
সবুজ মাঠে নামলো যখন জমকালো নীলকর
ধানের গানে প্রাণের বাঁশি বাজিয়ে তিতুমীর
মরণ বরণ করলো, তবু রাখলো উঁচু শির।
আমার ছিলো আর এক ভাই, জানো কি তার নাম?
দুরন্ত সেই উড়ন্ত নীলকণ্ঠ ক্ষুদিরাম,
আগলভাঙা পাগল হাওয়ার জন্যে বারো মাস-
যুদ্ধ করে জড়িয়ে নিলো গলায় রুদ্ধশ^াস।
আমার আরো দুই সোনা ভাই আসাদ-মতিয়ুর,
মিছিল নিয়ে পেরিয়ে গেলো রক্ত-সমুদ্দুর।
বর্ণমালায় স্বর্ণমালা গাঁথতে গেলো সেই-
রফিক, সালাম কেউ আসেনি, বাড়িতে কেউ নেই।
নিঝাপ পাড়া মেঘলা দুপুর, একলা আমার মা,
কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আর কষ্ট দিয়ো না।
শুরুতেই নামের সাথে অসঙ্গতি-অমিল উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষ্ণচূড়ার পরিচয় দিয়েছেন চমৎকৃতভাবে। ফুলকে চিনিয়েছেন এবং তার রং-প্রভাব বর্ণনা ও ধারণা দিয়েছেন। আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া কীভাবে ইতিহাসময় অগ্নিশিখা ধরে আছে এবং তা জ¦ালিয়ে মায়ের মনকে ভারাক্রান্ত করেছে কিংবা পুড়িয়েছে তার প্রতিচ্ছবি কবি এঁকেছেন কবিতায়। এতে উল্লেখ পাই যা আমাদের পড়াশোনার, দেখা ও অভিজ্ঞতার বাইরে। যেমন ‘সূর্যসেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, আসাদ-মতিয়ুর, রফিক-সালাম?- ক’জনাই বা ইতিহাস উলটে এদের বিস্তারিত সংবাদ নিয়েছি? কতটুকুই বা জেনেছি? আমরা অনেকেই জানি না, জানার সুযোগও অনেক সময় হয় না। কিন্তু অজানা-অদেখা সেই ইতিহাস কিশোর বিদ্যার্থীরা তো বটেই নতুন প্রজন্মও জানতে পারবে এ কবিতাটি পড়ে। এতে তার ইঙ্গিত ইশারা প্রচ্ছন্নভাবে রূপায়িত। তৃতীয় স্তবক থেকে সে-ইতিহাসের ধারা শুরু। সূর্যসেন ব্রিটিশের ২০০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মহানায়ক।চতুর্থ স্তবকে মহীয়সী যোদ্ধা প্রীতিলতার প্রচ্ছন্ন দেশপ্রেম, ভয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জয়গাথা, পঞ্চম স্তবকে অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের জীবনবাজি লড়াই, মুক্তির সংগ্রামে জীবন বিলিয়ে দেয়া অকুতোভয় ক্ষুদিরামের মহান ইতিহাস এবং ষষ্ঠ স্তবকে ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের নায়ক আসাদ-মতিয়ুর এর বীরত্বগাথা। স্বরবৃত্তে রচিত কবিতাটির ছন্দ স্বতঃস্ফূর্ত, উপমা-উৎপ্রেক্ষা যুতসই, সব মিলিয়ে অনবদ্য। এ কবিতা সুজন বড়–য়ার একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ প্রসঙ্গে এ অঙ্গনের আরেক শক্তিশালী কবি রাশেদ রউফ বলেন, ‘কৃষ্ণচূড়ার কাছে’ শীর্ষক কবিতায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। উঠে এসেছে সূর্য সেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, আসাদ-মতিয়ুর, রফিক-সালামের গৌরবগাথা। ছন্দে, মিলে, অন্ত্যমিলে, অনুপ্রাসে, উপমায়, চিত্রকল্পে, বক্তব্যে কবিতাটি সুজন বড়–য়ার সেরা কিশোর কবিতা। এ কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর আশ্চর্য আলোড়ন সৃষ্টি হয়।’
শিশু-কিশোর তথা শিক্ষার্থীদের ইতিহাস, ঐতিহ্যমুখী করার জন্য এমন কবিতার বিকল্প নেই। কবিতার শেষ দুটি চরণে কৃষ্ণচূড়ার কাছে আকুল আবেদন লাল দেখিয়ে মাকে কষ্ট না দেওয়ার। বলা বাহুল্য ‘একলা আমার মা’ কথাটা হারিয়ে যাওয়া মহানায়কের গর্ভধারিণী নয়, এ-মা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। দেশের জন্যে যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের বীরত্বগাথা এখানে অকৃত্রিম ও অকৃপণভাবে তুলে ধরেছেন কবি।
কবি সুজন বড়–য়ার প্রায় সব কবিতাই দেশ-মাটি-স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবাসার প্রতিধ্বনি। কিশোর-তরুণদের দেশপ্রেমে ও মুক্তিচেতনায় উজ্জীবিত করতে কবিতার এমন ইতিবাচক আবেদন অত্যন্ত প্রয়োজন। এ কবিতাজোড়ার পঙক্তিবিন্যাস, সম পর্ববিন্যাস, ভাবরস, শব্দচয়ন নির্মাণশৈলী এক কথায় উত্তীর্ণ।
সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘ঘড়ির ভেতরে যন্ত্রের কারিগরি না জেনেও আমরা ঘড়ি ব্যবহার করি দিব্যই, সঠিক সময়টা চাই ঘড়ির কাছে, তা পেলেই খুশি। কবিতাও তাই। তার ভেতরের করণটা থাকে ঘড়ির মতোই ঢাকনার তলায়- কাঁটা দেখার সময়, কবিতা দেখায় স্বর-সুর-ধ্বনিসমেত একটা অনুভব।’ এ অনুভব আমরা অনুমান করতে পারি উপরে বর্ণিত দুটি কবিতায়। শিশু-কিশোরদের দেশমাতৃকার প্রতি উজ্জীবিত করতে, ভাষা ও ঐতিহ্যে প্রাণিত করতে এ ধরনের কবিতা অত্যন্ত জরুরি।