সাগর, প্রাচীন স্থাপত্য আর পাহাড় একান্তে যেখানে

আনোয়ারা

নিজস্ব প্রতিনিধি, আনোয়ার »

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত দেখতে চাইলে কক্সবাজার যেতে হবে, পাহাড় দেখতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আর প্রাচীন নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়। তবে পাহাড়, সাগর আর পুরনো ইতিহাস ঐতিহ্য সবকিছুর সৌন্দর্য একই সাথে উপভোগ করা যায় আনোয়ারা উপজেলায়। জানা গেছে, দেয়াং পাহাড়ের আবহমান সৌন্দর্য আর রূপসী কন্যা পারকি সৈকতের রূপ দেখে কেড়ে নিতে পারে যেকোনো ভ্রমণ পিপাসুর মন।

সাথে যদি থাকে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে প্যারাবনের মতো এক পিকনিক স্পট তাহলে তো ভ্রমণ স্পটের শীর্ষেই থাকবে আনোয়ারার অবস্থান। এত আনন্দ আর সৌন্দর্যের মধ্যে দিনশেষে একটু ভৌতিক জগতে ঘুরে আসলে মন্দ কি। বলছিলাম ভৌতিক পার্ক নামে পরিচিত হিলটপ পার্কের কথা। বিভিন্ন রাজাদের রাজগল্প তো খুব শুনেছি তবে স্বচক্ষে যদি একই জায়গায় কয়েকজন মহারাজার বাংলো ঘুরা হয় তাহলে ব্যাপারটা তো একদম জমে ক্ষীর। এই জায়গাটি হলো প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম সৌন্দর্যে ঘেরা আনোয়ারা উপজেলা।

পারকি সমুদ্র সৈকত : সন্ধ্যায় রক্তিম সূর্য দেখতে কার না ভালো লাগে। যদি তা হয় ঝাউগাছের শিকড়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে। হাতে রং চায়ের চুমকে। তাহলে এমন একটি মুহূর্তের জন্য চলে আসতে পারেন সাগরকন্যা নামে খ্যাত দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পারকি সমুদ্র সৈকতে। বারাশত ইউনিয়ন পরিষদ ২০১৩ সাল থেকে সৈকতকে পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলায় অবস্থিত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত এটি। এখানে রয়েছে পারকি সমুদ্র সৈকতে ঘোড়া, রাইডিং বোট, বসার জন্য বড় ছাতাসহ হেলানো চেয়ার, মজার খেলা রিং থ্রো ইচ্ছে করলে হাতের নিশানা পরখ করে দেখতে পারেন। এছাড়াও রয়েছে লুসাই পার্ক নামে সুবিশাল নান্দনিক এক পিকনিক স্পট।

গহিরা প্যারাবন : শঙ্খ নদী ও বঙ্গোপসাগরে কোল ঘেঁষে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এক নীরব প্রকৃতির মেলা। ঘন প্যারাবন আর সারি সারি ঝাউগাছ আর চোখ ধাঁধানো মনোরম দৃশ্য আপনার মনমেজাজ ফুরফুরে করার জন্য যথেষ্ট। তাই বর্তমানে আনন্দ ভ্রমণ কিংবা পিকনিক স্পটের বিকল্প হিসেবেও পর্যটকরা বেছে নিয়েছে এ অঘোষিত প্রাকৃতিক দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্থানকে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার গহিরা ১২ আউলিয়া এলাকায় এটির অবস্থান।

দেয়াঙ পাহাড় : কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বর্তমান আনোয়ারা-কর্ণফুলী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড়। ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে আসেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজ বণিকদের দেয়াঙ পাহাড়ে কুঠি ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল দেয়াঙ। এখানে রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক বড় উঠান মিয়া বাড়ি। বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ এর পুত্র উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী খান নাম নেন যিনি এই মিয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। রয়েছে দেয়াাঙয়ের রানি মা মারিয়া। ১৬০০ সালে নির্মিত দেয়াঙ গ্রামের রাস্তার দক্ষিণ দিকে মরিয়ম আশ্রম আর মা মারিয়ার গ্রোটো। এখানেই চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘মা মারিয়া তীর্থ উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। দেয়াঙ পাহাড়ে প্রথম বসতি স্থাপন করে ছিলো বাংলাদেশে আগত প্রথম খ্রিস্টান পরিবার। আর সেখান থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ ছড়িয়ে পড়ে। রয়েছে অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত ‘প-িতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ উপমহাদেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালফ। যা বর্তমানে বিলুপ্ত।

এছাড়াও রয়েছে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)র মাজার, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, চাঁদ সওদাগরের দীঘি, হযরত আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ (রহ.) মাজার, বাংলাশে মেরীন একাডেমি, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল), ডিএপিএফসিএল, কোরিয়ান ইপিজেড, কোস্টগার্ড অফিস, বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশন, বাতিঘর, রায়পুর, আকবরি মসজিদ, ছুরুত বিবির মসজিদ, প্রসন্ন কুমার জমিদার বাড়ি, মনু মিয়ার মসজিদ, মনু মিয়ার দীঘি, যোগেশ চন্দ্র রায়ের জমিদার বাড়ি, হিলটপ পার্ক, মেন্না গার্ডেন, স্বপ্ন কুটির, গহিরা সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, সাঙ্গু নদীর মোহনা, রাবার ড্যাম, বরুমচড়া, বন্দর বধ্যভূমি কমপ্লেক্স, আখতারুজ্জামান চৌধুরী স্মৃতি পার্ক, মিয়া হাজী দৌলত (রহ.) মাজার, সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ, ধলা বিবির মসজিদ, ওয়ান্ডার গার্ডেন, দোভাষীর হাট টিএন্ডটি ভবন, তৈলারদ্বীপ ব্রিজসহ নানা মন জোড়ানো চোখ ধাঁধানো রূপ সৌন্দর্যময় স্থান।

আনোয়ারায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের নিরাপদ রাত্রিযাপন নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে পর্যটন স্পটগুলোর আশেপাশে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক সব আবাসিক হোটেল।

পর্যটকদের থাকা খাওয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বিষয়ে সিভিউ হোটেলের মালিক মো. জাফর বলেন, স্বল্প খরচে আনোয়ারায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকি। পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে কাজ করে থাকি। তবে রাত্রিকালীন বিচে গিয়ে সমুদ্র উপভোগ করার মতো পরিবেশটা এখনো পারকিতে গড়ে উঠেনি। পর্যাপ্ত পরিমাণে লাইটিং এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহল থাকলে পর্যটকেরা রাতের বেলায় সমুদ্রে আসল রূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতো।

বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. রানা বলেন, পারকি সমুদ্র সৈকতে দিনের বেলায় ফোর্স টহলে থাকে। কিন্তু রিজার্ভ ফোর্স না থাকায় সারাক্ষণ কিংবা রাতের বেলায় ফোর্স মোতায়েন রাখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন ছুটিতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার আওতায় থাকে। আর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিচ এবং অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলো দেখবালের দায়িত্বে থাকে।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, আনোয়ারা হচ্ছে পর্যটনের সম্ভাবনাময় একটা উপজেলা। এখানে পাহাড়, সমুদ্র থেকে শুরু করে সব কিছু রয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্প শেষ হলে পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার উন্মোচন হবে। পারকি সমুদ্র সৈকতে ইতিমধ্যে শৃঙ্খলার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। পারকিতে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্সের কাজও চলমান রয়েছে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় আনোয়ারা পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।