নিজস্ব প্রতিবেদক »
চলমান মহাপরিকল্পনা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অংশীজন সভায় ছিল না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো প্রতিনিধি। শুধু সিটি করপোরেশনই নয়? চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না। আর এতেই বুঝা যাচ্ছে সমন্বয়ের চিত্র।
মহাপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনার জন্য সেভ দ্য চিলড্রেন, ইপসা ও ইউএনডিপির সহযোগিতায় অংশীজন সভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। গতকাল সিডিএ’র সম্মেলন কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় মহাপরিকল্পনা নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিডিএ’র উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মহাপরিকল্পনা প্রকল্পের পরিচালক আবু ঈসা আনছারী। মহাপরিকল্পনার উদ্দেশ্য, মাঠ পর্যায় থেকে কিভাবে উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে এবং গবেষণা পদ্ধতি ও এর প্রভাবগুলো উপস্থাপিত হয় প্রবন্ধে। এই মহাপরিকল্পনা শুধু সিডিএ’র নয়, সমগ্র চট্টগ্রামের। সকলেই এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। বিভিন্ন সংস্থা তাদের আওতাধীন ক্ষেত্রগুলো যেমন বাস্তবায়ন করবে তেমনি নাগরিকদেরও পরিকল্পনা মেনে কাজ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আর সমন্বয় ছাড়া কোনো পরিকল্পনায় সফলতা আসে না।
সমন্বয়ের বিষয়টি আরো গভীরভাবে উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক শাহজালাল মিশুক। তিনি তার প্রবন্ধে বলেন, চট্টগ্রাম শহরের অতীতের দুই মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এই পরিকল্পনায়ও যদি সমন্বয় না থাকে তাহলে তাও আলোর মুখ দেখবে না।
অধ্যাপক শাহজালাল মিশুক বলেন, চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, জলাবদ্ধতা, ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি রয়েছে। এসব দুর্যোগে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নগরবাসী। তাই এসব দুর্যোগ থেকে রক্ষায় পরিকল্পনার ছাপ থাকতে হবে। শিশুদের বিকাশের জন্য পার্ক ও খেলার মাঠগুলো রাখতে হবে।
শাহজালাল মিশুকের বক্তব্যকে সমর্থন করে সাং বাদিক ওমর কায়সার বলেন, এই নগরে ১৪ তলা একটি ভবনের সাথে লেগেই আরেকটি ভবন গড়ে উঠছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিডিএ দেখছে না। সিডিএকে সবার আগে ভবনগুলোর সেটব্যাক রুলস মানছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সিডিএকে মাঠে নামতে হবে। অন্যথায় কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। তাই সিডিএকে তার নিজের আইন প্রয়োগের বিষয়ে কথা দিতে হবে।
সমন্বয়হীনতার কারণে যে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হচ্ছে তা উল্লেখ করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সম্পাদক শহীদুল আলম। তিনি বলেন, সাধারণ একটা অংশীজন সভায় সকল সংস্থার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু তারা না থাকায় এই সভাটি সমন্বয়হীনতায় ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এভাবে চট্টগ্রামের সকল পরিকল্পনায়ও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানারস (বিআইপি)’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ এর সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি বলেন, নগরীর বিগত মাস্টারপ্ল্যানগুলোর ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে একটি নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করার প্রয়োজন হয়ে পরে। আবার এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গাইডলাইনও পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে বে-টার্মিনাল ও বিভিন্ন ফ্লাইওভার কথা উল্লেখ না থাকলেও যোগাযোগ খাত উন্নয়নের খাতিরে এইসব প্রকল্প নেয়া প্রয়োজন হয়ে পরে। এছাড়াও চউকের প্রশাসনিক কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য তিনি বর্তমান চউকের অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে মনিটরিং করার জন্য চউকের লোকবল বাড়ানোর অঙ্গিকার করেন। সিডিএ’র মাস্টারপ্ল্যানের সফল বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম নগরীর সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের সহিত সর্বস্তরের জনগণকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ বলেন, চট্টগ্রাম নগরী পূর্বে খেলার মাঠ, উন্মুক্ত ময়দান ও বিভিন্ন পার্কের সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ নগরী ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা ও প্রভাবশালীর প্রভাবে চট্টগ্রাম নগরী দিন দিন বদ্ধ নগরীতে পরিণত হচ্ছে।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন স্থপতি ইন্সটিটিউশনের চেয়ারম্যান আশিক ইমরান। এছাড়া সভায় বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান করেন ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ রাশিদুল হাসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান, দৈনিক প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক ওমর কায়সার, ঘাসফুলের চেয়ারম্যান ড. মনজুর উল আলম চৌধুরী, আইইবি’র সাধারণ সম্পাদক শহিদুল আলম প্রমুখ। সভায় অতিথি হিসেবে আরো মতামত রাখেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী, কাউন্সিলর মো. জহিরুল আলম জসিম, ইপসার পরিচালক পলাশ চৌধুরী, ইলমার নির্বাহী পরিচালক জেসমিন সুলতানা পারু, সেভ দ্য চিলড্রেনের ম্যানেজার সায়মন রহমান, ইউএনডিপির টাউন ম্যানেজার মো. সারোয়ার হোসেন খান, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের প্রধান নির্বাহী উৎপল বড়ুয়া, ডিএসকের প্রজেক্ট ম্যানেজার আরেফাতুল জান্নাত, মমতার সিনিয়র ডিরেক্টর স্বপ্না তালুকদার প্রমুখ। এছাড়া সভায় নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও যুব প্রতিনিধিরাও মহাপরিকল্পনা নিয়ে তাদের ভাবনা তুলে ধরেন।