নিজস্ব প্রতিবেদক »
নানামুখী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ছে মুদ্রণ শিল্প। পাশাপাশি হোঁচট খাচ্ছে সাহিত্য চর্চাও। এর অন্যতম কারণ কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া। প্রায় প্রতিদিনই দাম একটু-আধটু বেড়ে তিন মাসে কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছেছে। এরপরও থামছে না। লাগামহীন কাগজের দর বাড়ার পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধসহ ডলার, জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধি ও এলসি খুলতে না পারার কথা জানিয়েছে কাগজ ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকাশক ও কাগজ বিক্রেতাদের দাবি কাগজ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সিন্ডিকেট কাগজের দাম বাড়াচ্ছে। এজন্য তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
নগরের পাইকারি কাগজের বাজার আন্দরকিল্লা ঘুরে দেখা গেছে, তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে এক রিম কাগজের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তিন মাস আগে যে কাগজ রিম প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিলো তা বর্তমানে ৩ হাজার ১০০ টাকা। ১ হাজার ৯৫০ টাকা দামের কাগজ এখন ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এরপরও কাগজ বিক্রি হচ্ছে। তবে ক্রেতা নেই আগের মতো। কারণ ছাপাখানায়ও কাজ কম। ছাপাখানা চলছে। তবে গতি নেই আগের মতো। গ্রাহক কমেছে। প্রিন্টিং ব্যবসায়ীরাও কাজের অর্ডার নিচ্ছে মানুষের প্রয়োজন বুঝে। মানুষও প্রয়োজনের চেয়ে কম ছাপিয়ে সেরে নিচ্ছে কাজ। শিক্ষার্থীদের খাতা বরাবরই বিক্রি হচ্ছে। তবে কিনতে এসে ক্রেতাদের দর কষাকষি করতে হচ্ছে। এমনকি কাগজের দাম বাড়ায় ফটোকপির দামও বেড়েছে।
জানা গেছে, কাগজের মূল গ্রাহক ছাপাখানায়। শিক্ষার্থীদের কাগজের চাহিদা খুবই কম। ছাপাখানায় প্রায় কাজেই প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের দাম বেড়েছে। আর বাড়তি দামের প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বইসহ পুরো মুদ্রণ শিল্পে। এমনকি আগামী অমর একুশে বইমেলায় নতুন বই প্রকাশের সংখ্যাও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুদ্রণে ব্যবহৃত কাগজ, কালি, শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন চারুকলা প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী আনিস সুজন। তিনি বলেন, ‘কাগজসহ প্রতিটি কাঁচামালের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রাহক চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অতিরিক্ত ব্যয়ের বিপরীতে আয় না বাড়ায় মুদ্রণ শিল্পে ধস নেমেছে। তাই কাগজের দাম যেন মাত্রাতিরিক্ত না বাড়ে এজন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।’
বাজারে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের খাতা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গতবছর বিক্রি হতো ৪০ টাকায়। এ নিয়ে গোলাম রসুল মার্কেটের কাগজ ব্যবসায়ী আজগর হোসেন জানান, কাগজের দাম বৃদ্ধিতে শিক্ষা উপকরণের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে। এক বছর আগে যে খাতাটি শিক্ষার্থীরা ৪০ টাকায় কিনতো এখন তা কিনতে হবে ন্যূনতম ৬৫ টাকায়। এরপরও প্রয়োজন থাকায় খাতার কাগজের বিক্রি ঠিক আছে। মুদ্রণের কাজে ৮০ শতাংশ কাগজ ব্যবহার হওয়ায় আমাদের গড় বিক্রি কমে গেছে।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আন্দরকিল্লার কাগজ ব্যবসায়ী আহমেদিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ বলেন, ‘এক বছর আগে দেশের প্রথম স্তরের পেপার মিলে প্রতি টন কাগজের ক্রয়মূল্য ছিল ৭৭ থেকে ৮০ হাজার টাকা। কয়েক দফায় দাম বেড়ে ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা হয়েছে। এ দরগুলো কোনোভাবে স্থির থাকছে না। প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে রিম প্রতি বাড়ছে। দেশের কাগজ ব্যবসায়ীরাই এটি নিয়ন্ত্রণ করছে।’
এ নিয়ে বলাকা প্রকাশনীর প্রকাশক জামাল উদ্দীন বলেন, ‘যুদ্ধ, ডলারের দাম জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় কাগজের দাম বাড়বে তা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিদিন দাম বেড়ে তিন মাসে দ্বিগুণ দামে দাঁড়াবে তা অস্বাভাবিক। কিছুদিন আগে ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি বই করেছি। বইটি এক হাজার কপি প্রকাশ করতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বইটি তিন মাস আগে বের করলে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগতো। এভাবে বই প্রকাশ করলে বইয়ের দামও বাড়াতে হবে। আর দেশে পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। দাম বেশি হলে পাঠক আরও কমে যাবে। এতে সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও জানান, এ রকম চলতে থাকলে প্রকাশনা ব্যবসাই টিকে থাকবে না।