শুভ জন্মদিনে একজন মানবিক রাজনীতিকের জন্য শুভকামনা

মোহাম্মদ নুরখান

রাজনীতি। মানুষের জন্য করার, মানুষের ভালবাসা পাওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম। সেবার অকৃত্রিম এ মাধ্যমটিকে আমরা কেউ কেউ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে আবার কেউ কেউ নিজেকে উপরে ওঠার অন্যতম অবলম্বন হিসেবে মনে করে থাকি। আবার কেউ রাজনীতির মায়াজালে পড়ে মানুষের সেবায়, দেশের কল্যাণে নিজেকে নিরন্তর অকাতরে বিলিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মানুষের সেবায় নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া প্রচারবিমুখ এ’ রকম একজন মানবিক রাজনীতিক চট্টগ্রামের অভিভাবক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য, দেশের রাজনীতি আকাশের এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান লাহোর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ৬ দফা আন্দোলনের সাথে তিনি সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর পিতা মরহুম এস রহমান ছিলেন তৎকালীন স্বতন্ত্র এমপিএ। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতি আর সেবার মন্ত্রে যেমনটি উজ্জীবিত হয়েছিলেন তা থেকে বিচ্যুত হননি কখনও তিনি ক্ষণিকের তরেও। লাহোর থেকে স্বধামে ফিরেই একজন খনিজ প্রকৌশলী হিসেবে উচ্চ পদের চাকরির মায়া বা অর্থ উপার্জনের মোহ ত্যাগ করে তিনি পুরোদমেই নিজেকে জড়িয়ে নিলেন রাজনীতির সাথে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও সোনার চামচের প্রত্যাশা করেননি কখনও ফেলে আসা দিনগুলোতে। যুদ্ধের মাঠে মেথরের দেয়া পোড়া মরিচ দিয়ে বাসি পান্তা ভাত যেমনটি খেয়েছেন, তেমনি আবার রাজনীতির মাঠে নিঃসংকোচে খেয়ে না খেয়ে রাত-বিরাত ছুটেছেন অবিরাম দিকবিদিক। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার সফরে আসলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্মানে তাঁর হোটেল সাইমনে নৈশ ভোজের (ক্যান্ডেল লাইট ডিনার) আয়োজন করলেন। পাশে বসেই বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়ন করালেন। ডিনারের পর অন্যদের সাথে তিনিও গেলেন মোটেল উপলে। বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন বিছানায়। নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সবাই বঙ্গবন্ধুর চারপাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। তাঁর কথাগুলো যেন এক একটি অমিয় বাণী। এক পর্যায়ে এডভোকেট নুর আহমদকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘এ নুর আহমদ মাওলানা ফরিদকে ডিফিট (পরাজিত করতে) দিতে পারবি? নুর আহমদ বললেন, মাননীয় বঙ্গবন্ধু, আপনি দোয়া করলে পারবো’। মাওলানা ফরিদ ছিলেন সে সময়কার মুসলিম লীগের একজন বেস্ট পার্লামেন্টেরিয়ান। নুর আহমদের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘তোরা আমারে ১৫১ টা সীট আইনা দে আমি দেখাইয়া দিমু’। এ দেখাইয়া দিমুর মধ্যে কি নিহিত ছিল পরিণামদর্শী মোশাররফ হোসেনের সেটি আর বুঝতে বাকি রইল না। ৭০ এর নির্বাচনে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি এমপিএ হলেন। ১৯৭১ -এ তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশ কখনও স্বাধীন হবে না। ৭ মার্চের ভাষণ ও মোটেল উপলে বলা বঙ্গবন্ধুর সে কথাটির সাথে চরম সাযুজ্য খুঁজে পেলেন তিনি। আর তাই মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নিজেও। ছুটে যান ছাতক সিমেন্ট কারখানায় বিস্ফোরকের খোঁজে। উদ্দেশ্য শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া।তাঁর এ অভিপ্রায়ের কথা তিনি বঙ্গবন্ধুকেও জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে তাঁর বুকে হাত রেখে বললেন, ‘সাবাস তুই এক্সপ্লোসিভ যোগাড় করে অর্ধেক ঢাকায় রেখে যাবি আর অর্ধেক দিয়ে শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিবি।’ কিন্তু ডেটোনেটর না পাওয়ায় বিটুমিন ও কেরোসিন দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মীরসরাই’র শুভপুর ব্রিজের কাঠের অংশে তিনি তাঁর সাথীদের দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তাঁর এ ভাবনার প্রতিফলন ঘটান। এ শুভপুর ব্রিজটিই ছিল সে সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এ ব্রিজে অগ্নিসংযোগ করার মধ্য দিয়ে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও নিখাদ দেশপ্রেমের পরিচয় ফুটে ওঠে। ব্রিজটি পুনরায় যান চলাচল উপযোগী করে এবং মহাসড়কের সকল ব্যারিকেড সরিয়ে কুমিল্লা থেকে রওনা হওয়া পাকিস্তানী সেন্যবাহী ২৬টি সাঁজোয়া যানের চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে প্রায় দশ দিন সময় লেগেছিল। যার কারণে এ’ দশ দিন চট্টগ্রাম মুক্ত ছিল। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে রাউজানের এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, সেদিন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যদি শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে না দিতেন তাহলে পাকিস্তানী সেনারা চট্টগ্রামে প্রবেশ করে ২ লাখ মানুষকে হত্যা করতো। একজন এমপিএ হয়েও ভারতের চাকলালা বিমান বন্দরে সিইনসি স্পেশাল ট্রেনিং গ্রহণ করে দেশের অভ্যন্তরে বহু অব্যর্থ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের নেতৃত্ব দেন তিনি। মীরসরাই’র অছি মিয়া ব্রিজ, সীতাকু-ের ইস্টার্ন কেমিক্যাল ব্রিজ ধ্বংস এবং সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি অনন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অছি মিয়া ব্রিজে সাত দিন এবং ইস্টার্ন কেমিক্যালের পাশের ব্রিজে টানা পনের দিন প্রচ- যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিরোধ করে রাখেন।এক পর্যায়ে তিনি তাঁর অন্যান্য সাথীদের নিয়ে দুটো ব্রিজই ধ্বংস করতে সক্ষম হন। পরিকল্পনা করলেন ইস্টার্ন রিফাইনারি ধ্বংসের। যেন পাকিস্তানী সৈন্যদের তেলের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। যেমন পরিকল্পনা তেমনই কাজ। ক্যাম্পের অনেককেই বলা হলো দায়িত্বটি নিতে; কিন্তু কেউ সাহস করলেন না। কারণ পুরো অপারেশনটি ছিল আত্মঘাতিমূলক। কিন্তু যার কাছে সর্বাগ্রে দেশ, মৃত্যু বা কোন শংকা কখনও তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে না। অমিত সাহসী মোশাররফ হোসেন প্রশিক্ষিত ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ৬.৫ ফুট দীর্ঘ আরসিএল গান নিয়ে বর্ষার কর্দমাক্ত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে দেশের ভেতরে ঢুকে চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ীতে নির্দিষ্ট শেল্টারে আশ্রয় নিলেন। এ যেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। ইস্টার্ন রিফাইনারি এলাকায় গিয়ে ছক আঁকলেন আক্রমণের। ইস্টার্ন রিফাইনারির পাশেই কর্ণফুলী নদী। ওপারেই আনোয়ারা। সিদ্ধান্ত হলো আনোয়ারা থেকেই আরসিএল গানটি ছোঁড়ার। পরদিন তিনি সাথীদের নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন শেল্টারে। মুহূর্তেই শুরু হলো শেল্টার লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ। মোশাররফ হোসেন ও তাঁর সাথীরাও পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিরোধ শুরু করলেন সর্বশক্তি দিয়ে। এক পর্যায়ে মোশাররফ হোসেন লক্ষ্য করলেন বদিউল আলম ছাড়া তাঁদের অন্য সাথীরা আর কেউ নেই। এটি বুঝতে পেরে তিনি এবং তাঁর সাথী বদিউল আলম শেল্টারের বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে অনেক কষ্টে পার্শ্ববর্তী ২৪ ফুট উঁচু নালায় লাফিয়ে পড়েন। এতে তার পা মচকে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচ-ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। স্থানীয় মেথরদের সহযোগিতায় সেদিন তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। পরবর্তীতে ভারতে ফেরার পথে রামগড় চাপলাইশ্যা পাহাড়ে তিনি আবারও পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এদিনও পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ হয় দীর্ঘক্ষণ। ক্লান্ত শরীরে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। কখন যে চোখে ঘুম নেমে আসলো টেরই পেলেন না। যখন ঘুম ভাঙলো দেখলেন পুরো শরীর তাঁর রক্তে ভেজা। প্রথমে মনে করলেন শত্রুর আক্রমণ হলো কি না। পরে বুঝলেন অসংখ্য জোঁক রক্ত খেয়ে তাঁর শরীরের সাথে লেপটে আছে।
১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের পরদিন সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস চত্বরে তিনি জননেতা এম এ হান্নান ও রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। যুদ্ধের মাঠে তিনি জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠসহ সকল প্রতিরোধ কর্মকা-ে তিনি ছিলেন সম্মুখ সারিতে। স্বাধীনতার পর তিনি নেমে পড়েন দেশ গড়ার কাজে। হলেন রেলওয়ের প্রশাসক। ৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি তৎকালীন মোসতাক সরকারের প্রতিমন্ত্রী পটিয়ার নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের অনুরোধ করেন। বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে কাঁদতে তিনি তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন এবং বলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে। পরে চট্টগ্রাম এসে নন্দনকাননের বাসায় বঙ্গবন্ধুর জন্য মিলাদের আয়োজন করলেন।
জিয়াউর রহমান যখন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তখনকার একটি ঘটনা। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান জেলা পরিষদ মিলনায়তনে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা ডাকলেন। সাবেক এমপিদেরও সভায় থাকতে বলা হলো। সাবেক অন্য এমপিদের সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন । এক পর্যায়ে তাকে বক্তব্য দিতে বলা হলো। সভার শুরুতেই জিয়াউর রহমান সবার উদ্দেশ্যে বললেন সবাই যেন মন খুলে কথা বলেন। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই জিয়াউর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মেজর জিয়া, যুদ্ধে আমি আর আপনি একসাথে ছিলাম। যুদ্ধের সময় আমরা অস্ত্র দিয়ে ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাঠিয়েছিলাম দশজন রাজাকারকে হত্যা করার জন্য। সে সময় তারা দু’জন রাজাকারকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও বাকিরা বেঁচে যায়। দুর্ভাগ্যজনক যে, সেদিনের বেঁচে যাওয়া রাজাকারদের পাঁচ জন আজ সামনের সারিতে বসা’। তখন হলের ভেতর উপস্থিত সবাই মোশাররফ হোসেনের এমন সাহস দেখে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন রহমান সাহেবের ছেলে বলে কি এসব! সেদিন তিনি বলেছিলেন ‘আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে হবে তারপর অন্য কাজ। আর মনে রাখবেন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে থাকতে এদেশকে কোন অবস্থাতেই পাকিস্তান হতে দেওয়া হবে না’। তখন হলের বাইরে বারান্দায় উপস্থিত সকলেই জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন তিনি সে রাতেই গ্রেফতার হবেন। এভাবেই তিনি নির্জলা সত্য উচ্চারণ করেছেন নির্দ্বিধায়, জেল কিংবা মৃত্যু অবধারিত জেনেও। জিয়াউর রহমান কয়েক দফায় তাঁকে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তখনকার একটি ঘটনা। জিয়াউর রহমান বিভিন্ন জনকে দিয়ে তাঁকে খবর পাঠালেন যেন তিনি সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনি যাননি। একদিন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম এর সাথে দেখা। তখন তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান। তিনি বললেন, চীফ আপনাকে দেখা করতে বলেছে, একটু দেখা করেন। জিয়াউর রহমানকে তখন সবাই চীফ হিসেবেই জানতো। অবশেষে তিনি বঙ্গভবনে গেলেন। জিয়াউর রহমান কেবিনেট মিটিং থেকে ছুটে আসলেন। অনেকক্ষণ গল্প করলেন এবং এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান তাঁকে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। অনুরূপ অনুরোধ ছিল এরশাদ সাহেবেরও। তিনি দৃঢ়ভাবে দু’জনের অনুরোধই প্রত্যাখ্যান করেন। আরেকটি ছোট্ট ঘটনা। জিয়ার সময়ের। মোশাররফ হোসেন একদিন ঢাকা ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। সেখানে দেখা হলো তৎকালীন জিয়া সরকারের মন্ত্রি জেনারেল শিশুর। তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কর্নারে গল্প করছিলেন। মোশাররফ হোসেনকে দেখিয়ে তিনি ওদের উদ্দেশ্যে বললেন খড়ড়শ ধঃ ঃযরং সধহ.ঐব যধং মঁঃং ঃড় ংধু হড় ঃড় ঃযব যরমযবংঃ ধড়ঁঃযড়ৎরঃু. ও ংধষঁঃব যরস. জিয়ার মন্ত্রি সভায় তাঁর যোগ না দেয়ার বিষয়টি তখন অনেকেই জানতেন। জেনারেল ওসমানী যখন জনতা লীগ করলেন তখনকার কথা। তিনি মোশাররফ হোসেনকে ফোন করলেন। তিনি বললেন, মোশাররফ সাহেব আমিতো একটি দল করেছি; জনতা লীগ। আপনি আমার দলে জয়েন করেন। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, আমিতো অলরেডি দল করি। আওয়ামী লীগ। আপনার দল কেন করবো? একই রকম অনুরোধ যখন কে এম ওবায়দুর রহমান করলেন, তাকে খুব তির্যক ভাষায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং তাকে চট্টগ্রাম না আসার জন্য বলেন। কে এম ওবায়দুর রহমান তাঁর কথায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন যা পরবর্তীতে অনেককে বুঝিয়েছিলেন। ১৯৮৬’র একটি ঘটনা। কক্সবাজারে একটি কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন হচ্ছিল। এ কেন্দ্রে ভোট হচ্ছে ছয় হাজার। অন্যান্য কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাঁচ হাজার ভোটে এগিয়েছিল। সামান্য ভোট পেলেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিতে আসবে।ভোটের আগের দিন রাতে মোশাররফ হোসেন ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু হোটেল সায়মন থেকে নির্বাচন মনিটরিং করছিলেন। এ সময় একটি ফোন আসলো। বাবু ভাই ফোন ধরলেন। ওপার প্রান্ত থেকে ভরাট গলায় বললেন, আমি জিওসি জেনারেল নুরুদ্দিন বলছি। বাবু ভাই বললেন, জি বলেন। তিনি বললেন, আমি নির্বাচন নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। বাবু ভাই বললেন, এখানে মোশাররফ সাহেব আছেন, ওনার সাথে কথা বলুন। তিনি মোশাররফ সাহেবকে বললেন চৎবংরফবহঃ ফবংরৎবং ঃযব ংবধঃ. জবাবে মোশাররফ সাহেব বললেন আমাদের সভানেত্রীও এই সীটটা ফবংরৎব করেন, সুতরাং বুঝতেই পারছেন। এভাবেই ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশ গঠনের কাজে এবং ৭৫ পরবর্তীতে বিভিন্ন হুমকি ধামকির মাঝেও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে আছেন দৃঢ়চিত্তে হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম নিউমার্কেট চত্বরে তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিস্টার সুলতানের সামনে বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাঁর পায়ের রগ কেটে দেয় এবং কোমরে ছুরিকাঘাত করে। ১৯৯২ সালের ৮ মে তিনি ফটিকছড়িতে শিবির সন্ত্রাসীদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। এদিন বিবিরহাটে ফটিকছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের ২য় অধিবেশনের শুরুতে শিবিরের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এলোপাথারি গুলি চালিয়ে দু’জনকে হত্যা করে। পরবর্তীতে শহরে ফেরার পথে সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তকীর হাটে শিবিরের সন্ত্রাসীরা তার গতিরোধ করে। তারা মোশাররফ হোসেনের গাড়ি থেকে পঙ্গু খাইরুল বশরকে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মোশাররফ হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা তাঁর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁকে গালিগালাজ করতে থাকে। এ সময় তিনি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে পার্শ্ববর্তী খালে ঝাঁপ দেন। ঝাঁপ দিয়েই খালের মধ্যে কাদার উপর ক্রলিং করে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। যেখানে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন পরক্ষণেই সন্ত্রাসীরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেখানে ব্রাশ ফায়ার করেন। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় তিনি বেঁচে যান সেদিন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারী কোতোয়ালির মোড়ে ট্রাকের উপড় পুলিশ তাঁকে বেধড়ক প্রহার করে। নেত্রীর শত অনুরোধেও পুলিশের মন গলেনি তখন। এক পর্যায়ে তাঁকে মেরে আধমরা করে পাশের নালায় ফেলে দেয়া হয়। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাঁকে মিথ্যা অজুহাতে দেড় বছর কারাবরণ করতে হয়েছে। ১৯৮২ সালে নেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নতুন উদ্যমে তিনি দলকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। নেত্রীর সাথে তিনি চট্টগ্রাম – কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। জিয়াউর রহমান যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিলেন তখন তাঁর নন্দনকাননের বাসাটি ছিল সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। এরশাদ শাহীর সময় একটি ঘটনা তাঁর আপোসহীনতার গভীরতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাবে নতুন প্রজন্ম। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে।
মোশাররফ হোসেন ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের নামে উত্তরায় রাজউক কর্তৃক পৃথক দুটি প্লটের বরাদ্দ পত্র দেয়া হয়। তারা দু’জনই এ বরাদ্দ পত্র ছিড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তারা মনে করলেন যে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা আন্দোলন করছে, তাদের দেয়া প্লট নেয়াটা হবে আদর্শের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এভাবেই কোন লোভ বা মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি কখনও। ৭০ থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৭ বার এমপি হয়েছেন। ২ দফায় মন্ত্রী হয়েছেন। ৮৬’র সংসদে ছিলেন বিরোধী দলীয় হুইপ। দু’বার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ১ম দফায় ডিসি হিল এবং ২য় বারে জাম্বুরি ও বায়েজিদ পার্কের বাস্তবায়ন করেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশব্যাপী বহু ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। চট্টগ্রামের কাতালগঞ্জ ও পাঁচলাইশের ৭টি পরিত্যক্ত বাড়ি এবং নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩৬ টি বাড়িতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে চট্টগ্রামে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন সমস্যা অনেকটা লাঘব হবে। ঢাকার মতিঝিল, আজিমপুর, আগারগাঁও ও মিরপুরে সরকারি জরাজীর্ণ পুরাতন স্টাফ কোয়ার্টার ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। গত সরকারের সময় ঢাকার রমনা পার্কের সৌন্দর্যবৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেন তিনি। এজন্য অনেকেই তাঁকে পার্ক পাগলও বলে থাকেন। আসলেই মানুষটি শুধু পার্ক পাগলই নয়, তিনি দেশ পাগল ও দল পাগল একজন মানুষ।তাঁর হাত ধরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলীয় কার্যালয়টি ভেঙ্গে আধুনিক দশ তলা ভবনে রূপান্তর করা হয়। টিকাটুলিস্থ রোজ গার্ডেন ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। এখানেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের (তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ) আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁর হাত ধরেই এটি যাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। ওয়ান ইলেভেনসহ দেশ ও দলের সকল সংকটময় মুহূর্তে তিনি কখনও মাথা নোয়াননি অসত্য ও অসুন্দরের কাছে। বিশেষ করে নেত্রীর প্রশ্নে তিনি ছিলেন সবসময় নিরাপোষ-একরোখা। নিজ নির্বাচনী এলাকা মীরসরাইর জন্যও যে তিনি কেমন আন্তরিক গত সরকারের সময়কালে তাঁর মীরসরাই সফর দেখেই বুঝা যায়। এমন কোন শুক্র-শনিবার ছিল না যেদিন তিনি মীরসরাই সফর করেননি। নিজ এলাকায় দলকে সংগঠিত করতে ৪৫৪টি পাড়া বৈঠক করেছেন। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটিগুলোও গঠন করেছেন সম্মেলন করে। তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ফজলুর রহমান স্কুল এন্ড কলেজ এর চিত্র দেখলেই বুঝা যায় শিক্ষার প্রতি তাঁর কেমন অনুরাগ। মনের সমস্ত আবেগ ও ইচ্ছা দিয়ে সাজিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানটিকে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাস, উন্নত আবাসিক ব্যবস্থা, অবকাঠামোসহ সবকিছুর যোগান রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এস রহমান ট্রাস্ট সমাজ কল্যাণসহ এখানকার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সাহায্য করছে। মীরসরাইতে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। এখানে ২০ লাখেরও অধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে। মহামায়া মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন তাঁর জীবনের অনন্য পাওয়া। বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এ প্রকল্পের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তখন এটিকে রাষ্ট্রপতির পাইলট প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ৭৫ এর বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে আর পেরে উঠেননি। পরবর্তীতে তাঁরই কন্যার হাত ধরে তিনি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন এবং তাঁকে দিয়েই এটির উদ্বোধন করেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর যুদ্ধের সাথীরা দেরিতে হলেও তাঁর এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে উচ্ছসিত। আজ সমাজে শিষ্টাচার ও নীতি নৈতিকতার চরম আকাল চলছে। একদিন কিছু সংস্কৃতিকর্মী আসলেন তাদের একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি করার জন্য। ডিসি হিলেই অনুষ্ঠানটি হবে। ডিসি হিল যেহেতু তাঁরই করা, তাই এর মাধ্যমে তাঁর প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা জানানোই হচ্ছে সংস্কৃতিকর্মীদের মূল উদ্দেশ্য। তিনি জিজ্ঞেস করলেন অনুষ্ঠানে আর কে থাকবেন? তাঁরা বললেন প্রফেসর খালেদ সাহেব বিশেষ অতিথি থাকবেন। তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন, না না আমাকে প্রধান অতিথি করো না। প্রফেসর খালেদ সাহেব মুরব্বি মানুষ, ওনাকেই প্রধান অতিথি করো। আয়োজকরা প্রফেসর খালেদ সাহেবের প্রতি তার এমন শ্রদ্ধাবোধ দেখে কিছুক্ষণ তার প্রতি অপলক তাকিয়ে রইলেন।
পরে প্রফেসর খালেদ সাহেবকেই প্রধান অতিথি করে আয়োজকরা নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রফেসর খালেদ সাহেবকে নিজ গাড়ি করে এনায়েত বাজার তাঁর গন্তব্যে নামিয়ে দিলেন। এ ঘটনায় সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে তাঁর শিষ্টাচার ও নৈতিকতার গভীরতা সম্পর্কে। যা এখন বিরল বললেই চলে। রাজনীতিতে শিষ্টাচারের বর্জন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতা এখন মহামারিতে রূপ নিয়েছে অনেকটা। অনেকের গালিগালাজ,তীর্যক চাহনিতেও এ মানুষটি ন্যূনতম তিরিক্ষি মেজাজ দেখাননি কখনও কাউকে। অথচ আমরা এখন একে অপরকে যে কোনভাবে ডিঙিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকি সতত।
তাঁর জন্ম এক বনেদি পরিবারে। বিত্ত আর বৈভবের মাঝে। বেড়ে ওঠাও হয়েছে তেমনিভাবে। কিন্তু যে মায়ায় পড়ে রাজনীতিতে এসেছেন সেই জায়গাতেই সিক্ত হয়েছেন অগণিত মানুষের ভালবাসায়, নেতা-কর্মীদের আদর-মমতায়। নিজের পুরো জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষ-দেশের কল্যাণে। রাজনীতি করতে গিয়ে সম্পদ অর্জনের চাইতে হারিয়েছেন বেশি। আর তাই বর্ণাঢ্যময় এ সুদীর্ঘ জীবনে সাধারণ নেতা কর্মীর পাশে থেকে নিজেকে তিনি একজন কর্মীবান্ধব চিত্তবান মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের হাতেই তৈরি করেছেন অসংখ্য নেতা। তাঁর হাত ধরে আসা অনেক ছাত্রলীগ নেতা আজ জেলা ও জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নেতা বানানোর অন্যতম কারিগর হিসেবেও তাঁর আলাদা একটি পরিচিতি আছে। একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, নিরহঙ্কার, দেশপ্রেমিক এ চিত্তবান রাজনীতিকের আজ আশিতম জন্মদিন। এ শুভদিনে এ সুন্দর মানুষটির জন্য অফুরান শুভকামনা।

লেখক : দপ্তর সম্পাদক, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ