ফারুক আহম্মেদ জীবন »
ঢাকা মগবাজারের একটা ভাতের হোটেলে কাজ করে রতন। বয়স মাত্র দশ বছর। আসলে এ বয়সে ওর পড়াশোনা খেলাধুলা আর হৈ-হুল্লোড় করে হাসি-আনন্দে জীবনকাটানোর কথা।
কিন্তু সেটা আর রতনের ভাগ্যে জোটেনি।
কী করে জুটবে..
কথায় আছে না, অতি যত্নের জিনিস পিঁপড়ে খায়। রতনের বেলায়ও হয়েছে ঠিক তাই।
আসলে শিশুশ্রমিক রতনের মত কতো যে রত্ন যত্ন বিনে আজ অবহেলা অনাদর আর অবজ্ঞাতে পুষ্পের মত পাপড়ি মেলে মিষ্ট সুবাস বিলানোর আগেই কুঁড়িতেই যে ঝরে পড়ছে। সেসবের হিসাব আমরা কয়জনইবা রাখি?
এমনটা শুধু যে আমাদের দেশ বাংলাদেশে ঘটছে, তা কিন্তু নয়। সমগ্র বিশ্বের শহর বন্দর গাঁয়ে হাইওয়ের ফুটপথে রেলস্টেশনে রতনের মত কতো যে রত্ম অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত কঠিন সংগ্রাম করে চলেছে।
রতনের জন্মের পর ওর মা-বাবা বড় আদর কওে ছেলের নাম রেখেছিল রতন। আর তার তিনবছর পর রতনের একটা বোন হয় রতনের নামের সাথে মিল করে মেয়ের নাম রাখে রেণু। ওদের বাবা ছিল একজন বেবিট্যাক্সিওয়ালা। নাম বাঁধন। আর মায়ের নাম মায়া। সত্যিই বাঁধন আর মায়ার দুটি সন্তান রতন আর রেণুকে নিয়ে বেশ মায়ার বাঁধনে ঘেরা ছিল ওদের সুখের পরিবারটি। কিন্তু সে সুখ ওদের ভাগ্যে বেশিদিন সয়নি। আর তাই রেণুর জন্মের ছয় মাসের মাথায় একরাতে ওদের বাবা বাঁধন যাত্রী নামিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। ওদের সংসারে নেমে আসে অমানিশায় ঘেরা ঘোর অন্ধকার। ওদের বাবা বাঁধন বেচে থাকতে মগবাজার এলাকায় একটা বাসাভাড়া নিয়ে ওরা থাকতো। কিন্তু রতনের বাবার মৃত্যুর পর ভাড়া দিতে না পারার কারণে মাথাগোঁজার ছাদটুকুও ওরা হারিয়ে ফেলে। ওদের মা মায়া ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, কী করবে, কোথায় যাবেÑ এই ভেবে। অবশেষে দয়াল মায়াকে বোনের মর্যাদায় বস্তিতে ছেলেমেয়ে দুটো
নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আর গার্মেন্টসে কাজ জোগাড় করে দেয়।কিন্তু বিধির লেখা খণ্ডন করবে এমন সাধ্য কার? আর তাই তো একদিন হঠাৎ গার্মেন্টস থেকে ফেরার পর রাতে স্ট্রোক করে মারা যায় ওদের মা- মায়া। মা-বাবাকে হারিয়ে একেবারে অনাথ হয়ে যায় রতন আর রেণু। আর তখন থেকে বোনটিকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য হোটেলে কাজ করে রতন।
রতন যে হোটেলে কাজ কওে একদিন সেই হোটেল মালিক দয়াল, তার ক্যাশ টেবিল থেকে রতনকে ডাক দিলো এই রতন রতন, শুনতে পাচ্ছিস?
রতন গ্লাস প্লেট ধুতে ধুতে জবাব দিলে এই তো মামা হাতের কাজটা শেষ করেই এহনি আইতাছি। তারপর রতন হাতের কাজ শেষ করে এগিয়ে এসে বললো, হ্যাঁ মামা, কন কি কইতাছেন? হোটেল মালিক দয়াল বললো, একটু তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারিসনে? এরকম নিম নিম করে কাজ করলে এদিকটা সামলাবি কখন. হুম? তারপর বললো. শোন, ঐ যে দেখতাছিস পিছনের টেবিলে এক ভদ্রলোক সাথে এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বসে গল্প করছে।
যা, ঐ টিবিলটাতে এই খাবারগুলো দিয়ে আই।
রতন জ্বি, আচ্ছা এহনি যাইতাছি মামা।
রতন টেবিলের কাছে খাবারের প্লেট নিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা বেখেয়ালি হয়ে হাত নেড়ে কথা বলতে গিয়ে রতনের হাতের সাথে ধাক্কা লেগে মোবাইলটা টেবিলের নিচে ফ্লোরের মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। আর রতনের হাতের খাবার প্লেট পড়ে জলের গ্লাস ছিটকে ওদের দুজনার কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা রাগে দাঁতের ওপর দাঁত রেখে কিড়মিড় করতে করতে ছোটলোকের বাচ্চা কি করলি কি এটা? এই বলে রতনের ছোট্ট গালটিতে কষে দিলো একটা থাপ্পড়। তারপর বললো, আমার শখের এতো দামি মোবাইলটা তুই ভেঙে দিলি? এই বলে আবার অন্য গালে মারলো আরেক চড়। হোটেলমালিক দয়াল রতনকে ঐভাবে মারতে দেখে ক্যাশ টেবিল থেকে দ্রুত ছুটে এসে বললো, ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে। ছোট মানুষ। ক্ষমা করে দিন ছেলেটিকে। রতন কাঁদতে কাঁদতে বললো। কিন্তু মামা উনার হাতের আঘাত লেগেই তো … কথা শেষ করার আগে দয়াল ইশারা
ইঙ্গিতে চুপ করতে বললো রতনকে। কিন্তু রতনের ঐটুকু কথায় ভদ্রমহিলা ওর গায়ের গেঞ্জি ধরে টানাহেঁচড়া করতে করতে বললো, তুই
আমার এত বড় ক্ষতি করে আবার মুখে-মুখে তর্ক করছিস? ফকিন্নি, ছোটলোকের জাত। যতো বড় মুখ না ততো- বড় কথা।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে থাকা ভদ্রলোকটি গায়ের জামা আর প্যান্টে পড়া খাবার জল দিয়ে মুছতে মুছতে বললো, দাও বেয়াদবটাকে একটু উত্তম-মধ্যম দিয়ে দাও। ভদ্রমহিলা তখন রতনকে বললো, জানিস আমার
এ মোবাইলটার দাম কতো? তোর চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ এমন দামি মোবাইল কেনা তো দূরে থাক, কখনো চোখে দেখেছে? হোটেল মালিক দয়াল আবারো বললো, ও বুঝতে পারেনি, ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম।
ভদ্রমহিলা বললো, আপনি চুপ করুন। এসব ইতর ছোটলোকদের আপনি হোটেলে রেখেছেন কেনো? তারপর আবার গালে চড় মারতে লাগলো। রতনের ছোট্টবোন রেণু মাঝেমধ্যে ওর ভাইয়ার থালা-বাসন মাজার কাজে সাহায্য করে। সে সময় রতনকে মারতে দেখে রেণু দৌড়ে এসে বললো ছাড়ো.. ছাড়ো… আমার ভাইকে মারছো কেনো? ছেড়ে দাও আমার ভাইয়াকে.. ছেড়ে দাও..বলছি। তখন ঐ মহিলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রতনকে। রতন ছিটকে গিয়ে পড়লো অন্য এক টেবিলের কাছে। টেবিলেরর পায়ার কার্নিশে রতনের কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। হৃদয় হোটেলে ঢুকতেই এতটুকু দৃশ্য দেখলো সে। সে রতনকে তুলে কপালের ক্ষতের জায়গায় পকেট থেকে টিস্যু বের করে চেপে ধরলো। রতন হাউমাউ করে কাঁদছে। তারপর হৃদয় সবকিছু শুনলো। রতন আর হোটেল মালিক দয়ালের কাছ থেকে।
হৃদয় ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাটিকে বললো, দেখতে তো ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। কিন্তু অমানুষের মত খাসলত কেনো? মানবিকতার জ্ঞানটুকুও নেই। এইটুকু বাচ্চার সাথে কেমন আচরণ করতে হয়, সে শিক্ষা কি পাননি?
ভদ্রমহিলা বললো, আপনি আবার কোন্ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর শুনি, যে আপনার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে?
হৃদয় বললো আমি কে সেটা এক্ষুণি জানতে পারবেন। তারপর মোবাইল করতেই পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হলো। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে ঘিরে ধরলো পুলিশ। হৃদয় তার পরিচয় কার্ড তুলে ধরে বললো, আমি এই জেলার ডিসি। তারপর পুলিশ ফোর্সদেও হুকুম দিলো, শিশু নির্যাতনের অপরাধের ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাটিকে গ্রেপ্তার করার জন্য।
দয়ালকে ডেকে বললো, আপনি জানেন, শিশুশ্রম অমার্জনীয় অপরাধ? দয়াল বললো, জানি স্যার।
আমি করাতে চাইনি। কিন্তু রতন আর ওর বোন এমনভাবে কাদঁতে কাঁদতে এসে বললো যে, আমি আর না করতে ….
রতন বললো, ওনার কোনো দোষ নেই স্যার। ওনাকে কিছু করবেন না। মামা ঠাঁই না দিলে যে
আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে যেতাম, স্যার।
রতনের মুখে শুনে ক্ষমা চোখে দেখলো ডিসি হৃদয়, হোটেল মালিক দয়ালকে। তারপর রতনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো সে। হৃদয় রতন আর রেণুকে পেয়ে সে যেনো তার ছেলেমেয়েকে ফিরে পেয়েছে। ওদের মত হৃদয়েরও দুটি সন্তান ছিল। যারা বছরখানেক আগে ওদের মায়ের সাথে সিলেটে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় হৃদয়। কেননা সে চাকরির কারণে ঐ যাত্রায় যেতে
পারিনি। যা হোক, এরপর রতনকে আর হোটেলে কাজ করতে দেয়নি হৃদয়। রতন আর রেণুকে সে তার বাড়িতে এনে নিজের সন্তানের মত করে বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ দিয়ে অতি যত্নে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে লাগলো। ডিসি হৃদয় অনাথ রতন রেণুকে ঠাঁই দিয়ে স্থাপন করলো এক মানবিক দৃষ্টান্ত।