মো. মহসীন »
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল ছিলো বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিবিধ গণদাবি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই গণদাবির প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনই মুখ্য সংগ্রামের গুরুত্ব বহন করেছিলো। তাই তৎকালীন সময়ে জোরালো গণদাবি ও রক্তাক্ত সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলো।
দেশের সর্বস্তরে তাই বাংলাভাষার প্রয়োগ ও প্রচলন সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে।
প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের নিজস্ব ভাষায় জ্ঞান চর্চার ফলে নিজ দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিধারা দ্রুত করে এবং যার ফলে দেশের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়োগে জটিল কর্মপ্রক্রিয়াগুলো সহজসাধ্য হয়ে উঠে। সেসব দেশই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এক কথায় মাতৃভাষার যথার্থ প্রয়োগে শিক্ষার প্রসারতা দ্রুত এগিয়ে যায়। আধুনিক উন্নত বিশ্বায়নের যুগে অন্যান্য দেশের সাথে টিকে থাকার প্রয়োজনে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার ব্যবহার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তক বাংলা ভাষায় রচিত এবং ইংরেজি ভার্সনের পাঠ্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করা গেলে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান অর্জন করা অবশ্যই সহজতর হয়ে উঠবে। মাতৃভাষায় উচ্চ শিক্ষায় ব্যাপক জ্ঞান লাভের পথ অধিক সহজবোধ্য করে থাকে। উচ্চশিক্ষায় বাংলাভাষার প্রয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বিবিধ পরামর্শ দিয়েছেন। এসবের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো: জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাধ্যতামূলক করা; বাংলা শব্দভা-ারের ব্যাপক উন্নতি সাধন, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গ্রন্থগুলোর বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা সৃষ্টি করা সম্ভব নহে। বলা যায়, সবক্ষেত্রে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেয়া আদৌ সমীচিন বলে মনে হয় না। যেহেতু সারাবিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলন সবচেয়ে বেশি এবং বিশ্বের কিছু কিছু দেশ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের সুদৃঢ়তার কারণে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে, সেহেতু একটি ভালো চাকরি, কর্মসংস্থান যাÑই বলি না কেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর।
এক্ষেত্রে বলা যায়, মাতৃভাষায় দুর্বল থেকে বিদেশি ভাষায় সবলতা অর্জনের চেষ্টা একপ্রকার দুরাশার নামান্তর। মাতৃভাষার সার্বিক প্রয়োগে সমাজ ও জাতিকে যে কোন বিষয়ে সুস্পষ্ট ফোকাস করা যায়। একুশের চেতনা মানেই তো বাস্তবতার আলোকে মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রসারতা, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার থাকলে মানুষ নিজেকে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে, পারিপার্শ্বিক এবং বৈশ্বিক পরিম-লকে সঠিক ও ভালোভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।
সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোন কারণে যখন কোনও জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে এড়িয়ে চলে, তখন জাতির নিজস্ব জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হতে পারে । বাংলাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহারে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এরফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষা-বৈষম্য তৈরি হতে পারে ।
এই বৈষম্যের কারণে ক্রমে সামাজিক -সাংস্কৃতিক পরিম-লে বিবিধ বৈষম্যের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ভাষার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
মাতৃভাষার সঠিক প্রয়োগের ফলে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকা- দ্রুত প্রসার লাভ করে, একুশের চেতনার যত মুল্যায়ন হবে, ততই জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি অনেক দৃঢ় ও মজবুত হতে পারে, ভাষাই জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক