এম আনোয়ার হোসেন »
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করছে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ (এনটিআরসিএ)। সম্প্রতি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ শিক্ষকদের তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাতে শিক্ষক নিবন্ধন ২০০৫ সালের প্রথম ব্যাচ হতে ২০১৫ সালের ব্যাচ পর্যন্ত যে সকল নিবন্ধনকৃত শিক্ষকরা বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের তথ্য সরবরাহ করার জন্যে জেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
এতে করে শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন সার্টিফিকেট জালিয়াতি, নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জালিয়াতি চিহ্নিত করার একটা মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে বলে আশা করা যায়। আর এটি যদি তাই হয় তবে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিরোধে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগপ্রার্থীদের মধ্য থেকেও অভিযোগ রয়েছে, ২০০৫ সালের প্রথম ব্যাচ থেকে ২০১৫ সালের ব্যাচ পর্যন্ত শিক্ষক নিবন্ধনপ্রাপ্ত শত শত শিক্ষক বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। নিবন্ধনপ্রাপ্ত অনেকে আবার যথাযথ নিয়োগের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। তথ্যসংগ্রহের মাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে অনেক প্রার্থী। কখনো কখনো এনটিআরসিএ-র নির্দেশনাকে অনেকেই অবজ্ঞা করেছে।
এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেক সময় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা সংশ্লিষ্ট অফিস সহকারিদের অজ্ঞতার কারণে শূন্য পদের যথাযথ চাহিদা দিতে না পারায় বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থী কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও এমপিও থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভুল তথ্য প্রদানের কারণে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক পদে যোগদান করতে পারেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে এ সমস্ত অজ্ঞতা বা গাফিলতি মেনে নেয়া যায় না। একটি বিষয় না বুঝলে সেটি বারবার বুঝে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষকে এ সমস্ত বিষয়ে আরো সজাগ থাকা প্রয়োজন। যারা সঠিক তথ্য প্রদান করে না বা তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে তাদের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ-কে মানবিক হয়ে কাজ করা দরকার। কেননা প্রায় প্রতিবছর তারা নিবন্ধন পরীক্ষা নিয়ে নিবন্ধন সার্টিফিকেট দিচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে।
কিন্তু নিবন্ধন সনদধারী প্রত্যেককে তারা চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় মেধা তালিকার ভিত্তিতে চাকরির সুপারিশ করে তারা নিবন্ধনকে অবহেলা করে যাচ্ছে। নিবন্ধন পাশ করার পর আবার মেধা যাচাই করা মানে অতিরঞ্জিত একটা ব্যাপার। একজন শিক্ষার্থী যখন বিসিএস পাশ করে তখন তাকে আর কোনো মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হয় না। সরাসরি নিয়োগ হয় নিজের পছন্দক্রমে।
অন্যদিকে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাও অনেকটা সেই আদলের। তাই চাহিদা অনুযায়ী নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ সকলকে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এখানে মেধার আর বাচবিচার করার প্রয়োজন হবে না। তাতে নাগরিক অধিকারও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
একজন শিক্ষার্থী যখন মাস্টার্স করার পর আবার নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এবং সেখানেও মেধা তালিকার নামে এক আজগুবি বাছাই পর্ব চলে তখন ওই শিক্ষার্থীর অনার্স,মাস্টার্স ও নিবন্ধন পরীক্ষার আর কী মূল্য থাকে ? হয়তো মেধার সংজ্ঞাও নতুন করে সংজ্ঞায়িত হওয়া দরকার। প্রবর্তিত জাতীয় মেধা তালিকা দিয়ে হয়তো নিয়োগের ক্ষেত্রে শহর-নগর, গ্রাম পর্যায় বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রত্যেক নিবন্ধন ( ১ম ব্যাচ হতে) সনদপ্রাপ্তদেরকে যথাযথভাবে সুপারিশ করে চাকরি প্রদান করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিসিএস করা সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও বদলি ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। তাতে করে অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রে একগুয়েমি ভাবটা দূরীভূত হয়ে শিক্ষাকার্যক্রম উন্নত হতে পারে। এ সব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে আরো এগিয়ে আসা দরকার।
এছাড়াও শিক্ষকদের এমপিও এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও এমপিওভুক্তকরণ নিয়ে বিভিন্ন জটিলতা, দুর্নীতি, অনিয়ম আগেও ছিল এখনো কমবেশি রয়েছে। অনেক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো জমি নেই কিন্তু এমপিও দেয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তকরণ করা হয়েছে। এ সংবাদ শুনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাতারাতি পাকা করা হয়েছে গত বছর। দুর্নীতি প্রতিরোধে এ সমস্ত অনিয়মকে আরো লাগাম টেনে ধরতে হবে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে। মাউশিকে এ সমস্ত অনিয়মের জায়গায় হাত দিতে হবে। প্রয়োজনে দুদকের সহযোগিতা নেয়া যায়।
বর্তমানে এমপিও নীতিমালা কমিটি এমপিও নিয়ে কাজ করছে। নতুন এমপিও নীতিমালা জারি করার কথা রয়েছে।
২০১০ সালের জনবল কাঠামো অনেকটা মান্ধাতা আমলের মত। যাতে অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ জনবল কাঠামোর আগাগোড়া না বুঝে নিয়োগ প্রদান করেছে। যাদের এমপিও করা সম্ভব হয়নি। অথচ এ সমস্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরির বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক আগে। যদিও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে শিক্ষক নিয়োগের। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের চাপ রয়েছে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।
কিন্তু মাউশি ধরে আছে তাদের জনবল কাঠামো। তাই এই জনবল কাঠামোকে যুগোপযোগী করা অত্যন্ত প্রয়োজন। যেমন, একজন শিক্ষক কোনো কারণে ইহকাল ত্যাগ করেছেন। সেখানে একটি পদ খালি হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবে। এই স্বাভাবিকতাকে জনবল কাঠামোর দোহাই দিয়ে অস্বাভাবিক করে তোলার কোনো মানে হয় না। পুর্বে এ পদটি যদি এমপিওভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে পদটি এমপিওভুক্ত হতে আপত্তি থাকার কথা নয়। নীতিমালা বা শিক্ষামন্ত্রণালয় অথবা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক এই ধরনের অযৌক্তিক যত আপত্তি আছে তা পরিহার করা প্রয়োজন। কেননা অনেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার আগে।
যেহেতু আইন হল মানুষের জন্যে, আইনের জন্যে মানুষ নয়। এ বিষয়টি ভাবতে হবে এবং এ বিষয়ের উপর আরো জোর দিতে হবে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে। এতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক জটিলতা কেটে ওঠবে, ফিরে পাবে স্বাভাবিকতা।
এনটিআরসিএ-কে যুগোপযোগী করে তোলার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন, শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন কোর্স অনুমোদনসহ পাশের হারের উপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও রহিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। ধরুন, একটি প্রতিষ্ঠনে কেউ পাশ করল না বা কাক্সিক্ষত ফলাফল হয়নি। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে মুদির দোকান করতে পারে না। ফলে তাদের পরিবারে নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা।
মনে রাখতে হবে, ভাল শিক্ষার্থী না থাকলে ফলাফলও ভাল হয় না। পরিবেশ থাকাও দরকার। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার আছে। করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা এবং বন্ধ রাখা যেমন সময়ের দাবি, তেমনি শিক্ষার পরিবেশ ধরে রাখার জন্যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং যুগোপযোগী করে গড়ে তোলাও প্রয়োজন। করোনাকাল হয়তো খুব সহজে শেষ হবে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা বা শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণে বিভিন্ন শর্ত বা জনবল কাঠামোর বিভিন্ন কঠোরতার কারণে অনেক শিক্ষক যেমন এমপিওভুক্ত হতে পারেনি তেমনি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হতে পারেনি।
এ সব ক্ষেত্রেও দুর্নীতি,অনিয়ম বেশ লক্ষ্য করা গেছে। ফলে অসংখ্য শিক্ষক-কর্মচারী নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, এমপিওকরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন ও এমপিওকরণের ক্ষেত্রে নীতিমালা সহজীকরণ করা না গেলেও যৌক্তিকক্ষেত্রে সংশোধন ও পরিমার্জন করা প্রয়োজন। তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন ঘটবে তেমনি অসংখ্য দুর্দশাগ্রস্ত শিক্ষকরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও স্কুল থেকেও বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদেরকে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে পরামর্শ, সুপারিশ নেয়া যেতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক