রতন কুমার তুরী »
লালনের গানের সুর কথা আর গায়কি যিনি ধারন এবং লালন করো গেছেন আজীবন তিনি কিংবদন্তি লোক শিল্পী ফরিদা পারভীর। সাম্প্রতিক জীবনের ওপারে চলে গেলেন লালন সংগীতের কিংবদন্তি কণ্ঠ শিল্পী ফরিদা পারভীন।
বাংলাদেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে লালন সংগীতকে সাধারণ মানুষ থেকে বোদ্ধা স্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য ফরিদা পারভীনের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। জীবনের ৭৩টি বসন্তের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন লালন সংগীত গেয়ে । অবশ্য দর্শক স্রোতাদের কাছ থেকে তেমন ভালোবাসাও পেয়েছেন। স্টেজ শো বলেন, টেলিভিশন শো বলেন এবং বিভিন্ন বিদেশ সফরে দর্শকদের কাছ থেকে একের পর এক লালন সংগীতের অনুরোধ আসতো আর ফরিদা পারভীন তা গেয়ে দর্শকদের মন জয় করে নিতেন।
‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানের কথার মতোই পাখিশূন্য হলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। যার কণ্ঠের সুবাদে এমন অসংখ্য গান প্রাণ পেয়েছিলো বিশ্বজুড়ে। কণ্ঠে লালনের গান হয়ে ওঠে শুধু সংগীত নয়, এক অনন্য জীবনদর্শন। জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন! তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি।
আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, “ভালো না লাগলে গাইবি না।” এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি। “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন”, লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, “আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।” এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়।
ক্যারিয়ারের শুরুতে দেশাত্মবোধক গান গাইলেও ফরিদা পারভীনের পরিচয় গড়ে ওঠে লালনকন্যা হিসেবে। তার কণ্ঠে ‘মিলন হবে কত দিনে, ‘অচিন পাখি’ গানগুলো আজও বাঙালির চেতনার অংশ হয়ে আছে।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে একুশে পদক পেয়েছেন ফরিদা। জাপান সরকার তাকে কুফুওয়া এশিয়ান কালচারাল পদক দিয়েছে। ফরিদা পারভীন কেবল নিজের গান করেননি; বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লালনের গান শিখিয়েছেন। তার উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় অচিন পাখি স্কুল, যেখানে শিশুদের শেখানো হয় আধ্যাত্মিক শক্তির মর্ম ও গান। ফরিদা পারভীন আজ আমাদের মাঝে নেই তবে তার গাওয়া লালন সঙ্গীত মানুষের মনে আজীবন থেকে যাবে। এ কিংবদন্তি শিল্পীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।