প্রদীপ খাস্তগীর »
ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা মোখতার আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিতে উদ্ভাসিত। অবিভক্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (১৯৬৬-৬৯), ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান (১৯৬৯-৭২), মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঁশখালী, আনোয়ারা, কুতুবদিয়া থানার আঞ্চলিক কমান্ডার এবং সাবেক সংসদ সদস্য মোখতার আহমদ ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের অন্তর্গত বাঁশখালী উপজেলার ২নং সাধনপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দমোজাফ্ফরাবাদ গ্রামের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল আলী সওদাগর।
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও ¯œাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস (পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) গঠিত হলে মোখতার আহমদ চট্টগ্রাম জেলা ফোরামের সদস্য হন। তখন তিনি ৬ দফা থেকে ১ দফার প্রবক্তা জননেতা মরহুম এম.এ. আজিজের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি ছাত্রনেতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৬ সালে মোখতার আহমদ অবিভক্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এস.এম ইউসুফ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়ে তিনি ছাত্র-গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় প্রধান ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী জননেতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলে মোখতার আহমদ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বাঁশখালীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় মিছিল, সমাবেশ করে জনগণকে উজ্জীবিত করতে লাগলেন। ২৩ মার্চ তিনি আন্দরকিল্লার বন্দুকের দোকান ও আইস ফ্যাক্টরি রোডের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনেও নেতৃত্ব দেন। সেখান থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাঁশখালীতে নিয়ে আসেন এবং স্থানীয় যুবকদের হাতে তুলে দেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য বাঁশখালী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা থেকে ছাত্র-যুবকদের রিক্রুট করে ত্রিপুরায় প্রেরণ করেন। সেখানে হরিণা ক্যাম্পে রিক্রুটকৃতদের মধ্যে কমিটেড ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন প্রেরণ করেন। ভারত থেকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার কবলিত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১নং সেক্টর কর্তৃক তিনি বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুতুবদিয়া থানার আঞ্চলিক কমান্ডার নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকার তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে প্রায় ৪ বছর তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
১৯৮২ সালের জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ১৫ দলীয় জোটের একটি গোপন বৈঠক থেকে ১০ জন নেতার সাথে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম এম.এ. ওয়াহাব, মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও ন্যাপ নেতা মরহুম এমএম শহীদুল্লাহ প্রমুখ ছিলেন। ১৯৮৮ সালে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া সংসদীয় আসন থেকে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালের ২৮ মে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বন্দর রেস্ট হাউজে তাঁর অনুগত নেতা-কর্মীদের নিয়ে পুরানো দল আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে (১৯৯২-৯৬) সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একুশে মেলা পরিষদ চট্টগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ চট্টগ্রাম-এর উপদেষ্টা এবং স্বাধীনতা মেলা পরিষদ চট্টগ্রাম ২০০৪-এর চেয়ারম্যান ও বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি ছিলেন। ২০০৬ সালের ২১ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
মতামত উপ-সম্পাদকীয়