অরূপ পালিত »
আমার তেমন কোনো পিছুটান নেই;
একসময় কিছুটা পক্ষপাত হয়তো-বা ছিলো
বিগত সনের পঞ্জিকার মতো এখনো তা ঝুলে আছে
নিষ্প্রয়োজন অবহেলায়।
আততায়ী অন্ধকারে বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা কিংবা
এরকম কিছু একটা হয়তো অবশিষ্ট ছিলো:
এই অকস্মাৎ আলোকিত ফেরিঘাটে (স্বীকারোক্তি)
ভাষাসাহিত্যে একুশে পদক ২০২৪ পেলেন চট্টগ্রামের বীরপ্রসবিনী পটিয়ার কৃতীসন্তান মিনার মনসুর। মিনার মনসুর একজন কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং সাংবাদিক। জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। তিনি কবি হিশেবে পরিচিত হলেও গদ্যেও তাঁর দ্যুতিময় বিচরণ সমানতালে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তির জন্যে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চাকসুর বার্ষিকী সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭৫-৮৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে অবিরাম লড়াই করে যাওয়া সৈনিক মিনার মনসুর। রাজনৈতিক সঙ্কটে দেশে টালমাটাল অবস্থায় সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে কমল চালাতে শুরু করেন। তাঁর কবিতা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে। বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি, মিথ, ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে তাঁর কবিতার বুকে। চোখে ছিল অভিনব স্বপ্ন এবং চেতনায় ছিল দ্রোহ। তাঁর কবিতা হৃদয়ের গভীরে ছুঁয়ে যায়, যেমন :
অহংকারী নারী
দ্যাখো, কী সুন্দর জিতে গেছি;
পাহাড় সমুদ্র পাখি বিচ্ছেদী সময়
সকলেই জিতে গেলো ব্যতিক্রম তুমি!
তোমার ব্যর্থতাগুলো গোপন ব্যর্থতাগুলো,
শব্দে শিল্পে এবং কবিতায়
কী অদ্ভুত নতজানু, দ্যাখো (এপিটাফ)।
এই শাশ্বত প্রেম যার হৃদয়ে বসবাস করে তিনি কবি মিনার মনসুর। সুন্দরের পূজারী সবাই। তার মধ্যে অন্যতম হলো নারী। নারী দিয়ে শুরু সৌন্দর্যের। কবি-সাহিত্যিক সবাই তো নারীকে নিয়ে সুন্দরের অপরুপ ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। কেউ প্রেমে পড়ে। আর কেউ প্রেমে মরে। প্রেমে পড়া কবির হৃদয় থেকে বের হয় সুন্দর-সুন্দর গল্প, কবিতা ও গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম একবার নয় অনেকবার প্রেমে পড়েছেন বলে সুন্দর-সুন্দর কবিতা গান উপহার দিয়েছেন আমাদের। আবার বিরহ-বেদনা-বিচ্ছেদ হতাশা এসেছিল দুজনের মাঝেও। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তাঁর বৌঠানের (কাদম্বিনী দেবী) আত্মহত্যার পর। ঠাকুর যখন বিয়ে করলেন কাদম্বিনী হতাশায় ভোগেন। কাদম্বিনী আসলে তাঁর ব্যর্থতার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কারণ কাদম্বিনীর একমাত্র অবলম্বন ছিল ঠাকুর। তাই অধিকার হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে নিজেকে নিস্তেজ করে ফেলা।
বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভেতরে লুক্কায়িত ছিল ভালোবাসা। নার্গিস, প্রমীলা দেবী এবং ফজিলতুন্নেসার প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নিজেকে তাতে সমর্পণ করেছেন। তিনি লিখেছেন :
আমি কবি হতে আসিনি,
আমি নেতা হতে আসেনি;
আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম
আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। …
হারানোর যন্ত্রণা খুঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছিল কবিকে। বলেছেন
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখো তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে …
কথায় বলে পুরুষ সৌন্দর্যের পূজারী আর নারী হলো সৌন্দর্যের আধার। তাই হৃদয়ে ভালোলাগা রেখেই ভালোবাসার কবিতা লেখা কবির স্বভাব। প্রেম ও দ্রোহের কবি মিনার মনসুরের কবিতায়ও কখনো-কখনো নারীকে দেখি সুবিধাবাদী পিংকিরূপে। যাকে কবি ডিচত্রিত করেছেন : ‘পিংকিরা চলিয়া যায় বারংবার কবিকে মথিত করে।’ আবার কখনো সেই নারীর রূপেই মিনার মনসুর মুগ্ধ হয়েছেন। স্বৈরাচারের রোষানলে নিষিদ্ধ হয়েছিল মিনার মনসুরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’। এত কিছুর পরও কবির কলম থামাতে পারেনি স্বৈরাচারী শাসক। তাঁর সাহিত্যচর্চায় প্রতিনিয়ত প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক সত্তার পরিচয় :
জানি, তোমার অদৃশ্য থাবা দুমড়েমুচড়ে দেবে
দক্ষিণের বালাখানা- থেমে যাবে ক্লান্ত বায়ুকল
সব, সবই কি থেমে যাবে!
তুমিই থামিয়ে দেবে মহাজাগতিক ঘড়ি? তুমি?
আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।
আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।
তাদের অকুতোভয় তরবারি আর ঝলমলে শিরোস্ত্রাণ
সাক্ষ্য দেবে যুদ্ধ জারি আছে, থাকবেই।
(যুদ্ধ জারি আছে)।
মিনার মনসুরের কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল অত্যাচার-অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধাচার। অত্যাচারী সামরিক শাসক নিষিদ্ধ করে দেয় তাঁকে। তিনি যে জাতির পিতার চেতনার উত্তরসূরি! কবি এখনো একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। সন্তান যখন প্রশ্ন করেছিল, বাবা, বঙ্গবন্ধুকে ওরা কেন মেরেছিল? যে-উত্তরটি তাঁর জানা আছে কিন্তু বলতে ঘৃণা হয় শিশুদের। ১৫ আগস্টের নির্মমতা-নৃশংসতা আর সকল পৈশাচিকতাকে হার মানিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড যে বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মিনার বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর প্রথম হয়েও বিভাগের শিক্ষক হতে পারেননি সামরিক স্বৈরাচারের রোষানলের কারণে। তিনি বুকে সাহিত্যধারণ করে লিখে চলছেন অবিরাম।
যদি বলি, জরাজীর্ণ পাতা তো ঝরেই যেতাম
কোনো এক চৈত্রে ঝড়ে কিংবা বিনা ঝড়ে;
ক্ষতি কী আজই যদি চুকেবুকে যায়
সব হিসাবনিকাশ! মুশকিল হলো
জগদীশচন্দ্র বসু অপঠিত রয়ে গেল আজও!
পাতাও কি ফেলে দীর্ঘশ্বাস? বলো, কে দেবে উত্তর
এই গূঢ় রহস্যের? শেষাবধি কেবা চায় যেতে?
যখনই যাও, বন্ধু, কিছু মনস্তাপ পোষা কুকুরের মতো
ঠিকই ঠুকবে মাথা নির্বিকার চৌকাঠে তোমারৃ
(আমি তার তাজা ঘ্রাণ পাচ্ছি)।
সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে লেখালেখি শুরু করা মিনার মনসুর সম্পাদক, প্রকাশক ও সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পঁচাত্তর পরবর্তীকালে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে যোগদানের আগে তিনি ‘সংবাদ’-এর সহকারী সম্পাদক এবং পরে ‘ইত্তেফাক’-এও কর্মরত ছিলেন।
কাঁটা তারে ঝুলন্ত যে ঝলমলে কিশোরীকে দেখছো, সে আমি।
এ মাত্র যার বক্ষ এফোঁড়-ওফোঁড় হলো ঘাতকের অদৃশ্য বুলেটে-
রুদ্ধবাক শীতলক্ষ্যা শোকে;- কাকেরা উৎসব করে যার ফুলে উঠা পেটে-
সেও অন্য কেউ নয়- আমারই হাড়-মাংসে তৃপ্ত হয় লোভের সুনামি।
এই যে ভবন ধসে পড়ে, লঞ্চ ডোবে, অগ্নিযজ্ঞে বলি হয় কত স্বপ্নসাধ-
অংকবিশারদ তুমি সংখ্যা বোঝো- তার চেয়ে ভালো বোঝো বিত্ত-অর্থবিল!
কংক্রিটের নীচে চাপা পড়ে থাকা- জলে ভাসা- আগুনে পোড়া যে-আর্তনাদ
হিম হয়ে আছে হিমালয়ে-মেরুতে মেরুতে- আমি সেই জীবন্ত ফসিল।
(পঙ্গু পরিত্রাণ)।
৭৫-পরবর্তীকালে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই সাহসী কবি ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেন ’শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ নামে একটি মাইলফলক গ্রন্থ। পঁচাত্তরের নজিরবিহীন নৃশংসতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটিই ছিল গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম স্মারক সংকলন। তাঁর লেখা এবং সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশটিরও বেশি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে : এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে, অনন্তের দিনরাত্রি, অবিনশ্বর মানুষ, আমার আকাশ, জলের অতিথি, কবিতাসংগ্রহ, মা এখন থেমে যাওয়া নদী, মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা, মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা, পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি, নির্বাচিত কবিতা, আমার আজব ঘোড়া।
অতল জলের টানে (গল্প), হেলাফেলার ছড়া, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : জীবন ও কর্ম (গবেষণা), শোষণমুক্তির লড়াইয়ে মধ্যবিত্তের ভূমিকা (প্রবন্ধ), জলপাইরঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট (কিশোর গল্পগ্রন্থ), সম্পাদনা : শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ, মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীরযোদ্ধারা।
মিনার মনসুর জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য এবং বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটির জীবনসদস্য। পেশাগত কারণে তিনি আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও নেপাল ভ্রমণ করেছেন। সামগ্রিক অবদানের জন্যে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর মধ্যে একুশে পদক, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিপদক উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা আলোকিতা তাহমিন মনসুর এবং এক পুত্র অদম্য স্বাপ্নিক মনসুরের জনক তিনি।