এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ »
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা দুনিয়া আজ টালমাটাল। সমগ্র বিশে^র কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। ঠিক এমন একটি কঠিন সময়ে বিশ^বাসী পালন করতে যাচ্ছে শ্রমিক অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন ’মহান মে দিবস’। প্রতিবছর মে মাসের প্রথম দিনে সারা বিশ^ব্যাপী মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের দিন মহান মে দিবস। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।
১৮৮৬ সালে পূঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরী এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখন দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেয়া যাবে না। দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করে। প্রায় তিন লাখ মেহনতি মানুষ ওই সমাবেশে অংশ নেয়।
আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে একসময় পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের মিছিলে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে এঞ্জেল, পার্কিনস, স্পিয়ার সহ ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হন আরো অগণিত শ্রমিক। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আতœহননও করেন। এতে বিক্ষোভ আরো প্রকট আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।
মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের উপর এ দিবসের প্রভাব সূুদূরপ্রসারী। এর প্রভাবে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা থেকে নেমে আসে ৮ ঘণ্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি নতুন অধ্যায়।
মে দিবস হচ্ছে গোটা পৃথিবীর শ্রমজীবী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করার দিন। শ্রেণিবৈষম্যের বেঁড়াজালে যখন তাদের জীবন বন্দি ছিল তখন মে দিবসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খুলে যায় তাদের শৃঙ্খল। পুঁজিবাদের দুর্বল দিকগুলোকে পুঁজিকরা অবৈধ অর্থলোভীদের আগ্রাসী দংশন থেকে রেহাই পেল কোটি কোটি শ্রমিক। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান গোটা বিশ্বকে উপহার দিল এই মে দিবস। মালিকপক্ষের সাথে মালিকÑশ্রমিক সম্পর্কেও নতুন ভাবনা এলো সম্পর্ক এক সময় উৎপাদন সম্পর্কের নিরিখে চলে আসলো শুধুমাত্র মে দিবসের স্বীকৃতির ফলেই।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে মে দিবসের সম্মানার্থে বাংলাদেশেও ১লা মে সরকারি ছুটির দিন। অতীতে এদেশের শ্রমজীবীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এদিবসটি পালন করতো। বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। কিন্ত করোনা ভাইরাসের ছোবলে বিধ্বস্ত এই সময়ের বাস্তবতা এখন ভিন্ন। করোনার বিস্তার রোধে চলছে লকডাউন। মরণঘাতী এই ভাইরাস থেকে জীবন বাঁচাতে মানুষের জমায়েত ও যান চলাচলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
আমাদের দেশে শ্রম আইনে আছে, সপ্তাহে ছয়দিন শ্রমিকরা কাজ করবে এবং প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি নয়। দ্ইু ঘণ্টা ওভারটাইম কাজ করানো যেতে পারে, অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই একজন শ্রমিকের ১০ ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ হতে পারবে না। এই অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা কাজের জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ হারে মজুরি দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই জোর করে বা শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় কাজ করাতে পারবে না। শ্রম আইনে রয়েছে, কারখানার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও মানবিক হতে হবে। দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার বিরুদ্ধে কঠোর বিধান রয়েছে। শ্রম আইনের লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে।
বর্তমান সময়ে কঠিন করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বিশে^র প্রায় সকল দেশ আজ অতঙ্কগ্রস্থ ও দিশেহারা। পৃথিবীর শতাধিক রাষ্ট্র খুব গুরুত্বের সঙ্গে মহান মে দিবস পালন করে তারাও আজ শঙ্কিত। মে দিবস সমগ্র বিশ^কে একটি বৈষম্য ও শোষণমুক্ত ব্যবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু করোনা কবলিত বিশে^ লকডাউন, আইসোলেশন ও সামাজিক দূরত্ব শ্রমজীবী মানুষের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে। ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেত গিয়ে শ্রমজীবী মানুষদের জীবিকা জীবিকা নির্বাহ আজ কঠিন অবস্থার সম্মুখীন। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে মেহনতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমাদের সবাইকে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
এই ভয়াবহ মহামারিতে সেবাখাতে শ্রমজীবী নারী-পুরুষের চাহিদা অনেক বেশি। চিকিৎসক, নার্সদের পাশাপাশি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার করোনা মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। আর এই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বৈশি^ক এই সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসা সেবায় শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব অপরিসীম। এদিক থেকে এবারের মে দিবস আলাদা গুরুত্ব বহন করছে।
করোনা কালীন সময়ে মানুষের জীবন রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা হয়েছে। বর্তমান লকডাউনে চলাকালে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথে চিকিৎসক ও শিল্পখাতের নিয়োজিতরা যাতে রাস্তাঘাটে অযথা নাজেহাল না হয় সংশ্লিষ্টদের সেদিকে নজর দিতে হবে। বর্তমান করোনাকালে গ্রামÑশহরের শ্রমজীবী মানুষ উৎপাদন ও সরবরাহের চাকা সচল রাখছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত তাদের সকল প্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ও শ্রমের মজুরি পায় তা সরকার ও মালিকদের নিশ্চিত করতে হবে।
ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকের শ্রমিক শ্রেণিকে আগলে রেখেছে। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা এখন শ্রমজীবীদের ভূষণ। ১৮৮৬ সালের রক্তঝরা সেই ১লা মে এখন সবার কাছে অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। করোনা মহামারীতে আমাদের সকলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে অসহায় শ্রমজীবীদের প্রতি। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী পরিবর্তন সূচনা অঙ্গিকারের প্রয়াস পায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক
























































