দেববর্ণা চক্রবর্তী :
‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়, এলো আমার মনে,
কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে, ঝরোঝরো বরিষণে …
রবীন্দ্রনাথের আষাঢ়বন্দনায় আমরা এভাবেই খুঁজে নিতে পারি সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি এবং সর্বকালের মহাকবি কালিদাসকে।
এখনো ঝুমবর্ষায় বা বর্ষার কালো মেঘ দেখে হৃদয়ের উৎকণ্ঠা প্রকাশের উপমা হিসেবে আমরা অনেকেই মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্য ‘মেঘদূত’-এর সেই প্রিয়াশোকে কাতর যক্ষের বর্ণনা দিয়ে থাকি। আর সেই মহাকাব্য এতটাই প্রভাবিত করেছে পাঠকহৃদয়কে যে, আষাঢ়ের প্রথম দিবস অর্থাৎ ইংরেজি বর্ষের ১৬ জুনকে ‘কালিদাস দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
সংস্কৃত সাহিত্যের অনেক কবির আবির্ভাবকাল বা জীবনীর নির্দিষ্ট সময়পঞ্জি পাওয়া যায়নি। মহাকবি কালিদাসের সময়কাল নিয়েও তাই রয়েছে মতভেদ। তবে সর্বাধিক প্রচলিত মতবাদটি হলো মহাকবি গুপ্তরাজাদের (২৭৫-৫৭০ খ্রি.) রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। শুধু সময়কাল নয় মহাকবির জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে মতভেদ।
কিংবদন্তি অনুসারে, কালিদাসের জীবনের প্রথমভাগ তেমন সুখকর ছিল না। বিদ্যাভিমানিনী স্ত্রীর পরিহাসভাজন হয়ে বনে-বনে ঘুরতে থাকলে তিনি সরস্বতী দেবীর সাক্ষাৎলাভ করেন এবং দেবী সরস্বতীর বরে কালিদাস মহাকবি হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মহাকবি গৃহে ফিরে ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’, এবং ‘রঘুবংশ’ এসব অমর গ্রন্থগুলো রচনা করেন। কালিদাসের জীবনের শেষভাগে তিনি এক লোভী বারবনিতার হাতে নিহত হন বলে জনশ্রুতি আছে।
মহাকবি কালিদাসের জীবনের অনেক অধ্যায় অজানা হলেও তাঁর রচনা আমাদের কাছে অগোচর নয়। শব্দশৈলীর পরিপূর্ণ গাম্ভীর্যে সকল মৌলিক রচনা তিনি সৃষ্টি করেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যের পরিম-ল বিস্তৃত করে গেছেন। প-িত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু হতে শুরু করে পাশ্চাত্যের জি মেয়ের, স্ক্রোইডার, গ্যেটে, শিলার প্রমুখ বিদ্বজ্জনেরা কালিদাসের রচনায় মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
‘মেঘদূত’ রচনা নিয়ে জামৃান কবি গ্যেটে বলেছিলেন, দঞযব ভরৎংঃ ধপয়ঁধরহঃধহপব রিঃয ংঁপয ধ ড়িৎশ ধষধিুং সধশবং ধহ বঢ়ড়পয রহ ড়ঁৎ ষরভব’. কবি কালিদাস যেন মানবজীবনের অন্তর্ধ্বনি শুনতে পেয়ে মানবজীবনের প্রতিটা স্তরকে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিরহ এবং প্রেমকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে এনেছিলেন পাঠকের সামনে।
বর্তমানে সংস্কৃত সাহিত্য খুব একটা চর্চা হয় না বলে আমরা অনেকে কবি কালিদাসকে জানতে পারিনি। একালের পাঠকেরা খুব সংস্কৃত সাহিত্য থেকে দূরে অবস্থান করায় এ সাহিত্য থেকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত সাহিত্যচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অথচ সব ভাষায় সাহিত্যচর্চা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেই সাথে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যও আমাদের পাঠ করা প্রয়োজন। কারণ, আমরা যদি আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে না জানি, তাহলে সামনে এগিয়ে যাবো ঠিকই, কিন্তু প্রাচীন সাহিত্যের রস ও প্রাচুর্যের গৌরব থেকে বঞ্চিত থেকে যাবো। বাংলা আষাঢ় মাস শুরুর এই মুহূর্তে মহাকবি কালিদাসকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়, যিনি আমাদের মনে সর্বপ্রথম আষাঢ়ের সাথে প্রকৃতি এবং প্রেমের সম্বন্ধ দেখিয়ে মানবজীবনে এক আলাদা করুণরসের সৃষ্টি করে গেছেন।
প্রকৃতপক্ষে আষাঢ় যতদিন প্রকৃতিতে থাকবে, ততদিন মহাকবি কালিদাসও বেঁচে থাকবেন।