ভূঁইয়া নজরুল »
নগরীর হালিশহর সাগর পাড়ে আগামীর বন্দর বলে খ্যাত বে টার্মিনালের জন্য ভূমি বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। দীর্ঘ আট বছর অতিবাহিত হলেও এখনও কাঙ্খিত ভূমির বরাদ্দ মেলেনি। ২০১৭ সালে প্রথম দফায় ৬৭ একর বরাদ্দ পেলেও বাকি থেকে যায় ৮০৩ একর ভূমি। সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি ৮০৩ একর ভূমির জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ টাকা চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে চিঠি লেখে। জেলা প্রশাসনের এই চিঠির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখে প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দের জন্য। এবার এই চিঠি চালাচালিতে কতটা সময় বা বছর যাবে সেটাই দেখার বিষয়।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন,‘ ৮০৩ একর ভূমির মধ্যে ৮০২ একর খাস জমি। খাসজমি ভূমি স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়েল ১৯৯৭ এর ৭ অনুচ্ছেব অনুযায়ী তা নৌ মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরের জন্য বলা হয়েছে। এখন জেলা প্রশাসন হস্তান্তর না করে খাসজমির অধিগ্রহণ মূল্য বাবদ ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ টাকা চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে চিঠি লেখে। ১২০ দিনের মধ্যে তা পরিশোধের জন্য বলা হয়েছে।’
বন্দর কি এই টাকা পরিশোধ করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমরা প্রতীকী মূল্যে এই জমি বরাদ্দের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। আর ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে সরকারকে তিন হাজার কোটি টাকা এবং পায়রা বন্দরকে ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে। প্রকারান্তরে টাকা পরিশোধও হয়ে গেছে। তাই বে টার্মিনালের ভূমি বরাদ্দের জন্য আমরা প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ চেয়েছি।’
খাস জমি প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালের উপ-সচিব (খাসজমি-১) মঈনউল ইসলাম বলেন,‘ সরকারি খাস জমি অপর একটি সরকারি সংস্থাকে এক টাকা প্রতীকী মূল্যে বা বিশেষভাবে বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি হলে ভূমির মূল্যের তিনগুণ অর্থ অধিগ্রহণবাবদ পরিশোধ করতে হয়।’
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালের উপসচিব ( অধিগ্রহণ-২) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের গত ৩০ জুন স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম বন্দর সুবিধাদি সম্প্রসারণ ( বে টার্মিনাল) শীর্ষক প্রকল্পের ৮০৩ দশমিক ১৭ একর ভূমির মধ্যে শূন্য দশমিক ৭৮ একর ভূমি ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং ৮০২ দশমিক ৩৮ একর ভূমি খাসজমি। খাসজমিগুলো খাস ভূমি স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়েল ১৯৯৭ এর ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সচিব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরের প্রস্তাবটি সরকার সাত শর্তে অনুমোদন দিয়েছে।’
ভূমি মন্ত্রণালয় যেখানে হস্তান্তরের অনুমোদন দিয়েছে সেখানে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রায়হান মেহবুব গত ৩০ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত এক আদেশে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ এর ৮(৪) ধারার বিধান অনুসারে ১২০ দিনের মধ্যে ৮০৩ দশমিক ১৭ একর ভূমির জন্য প্রাক্কলিত ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন থেকে ভূমি অধিগ্রহণবাবদ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পরিশোধের চিঠি পাওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান গত ৩১ জানুয়ারি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর তা প্রতীকি মূল্যে বরাদ্দের জন্য চিঠি লেখে। একইসাথে এই চিঠিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরের অনুমোদনের কথা এবং ইতিমধ্যে সরকারের তহবিলে তিন হাজার কোটি টাকা এবং পায়রা বন্দরকে ৫০০ কোটি টাকা দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন।
সরকারের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বে টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে ২০২৪ সালে তা চালু করার কথা কয়েক দফায় বলে গেছেন। বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বাকি দুটি টার্মিনাল পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বিদেশি দুটি কোম্পানি বাস্তবায়ন করার কথা।
২০১৩ সালে বে টার্মিনাল নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের পর ২০১৪ সালের মে মাসে ভূমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই সময়ে ভূমি বরাদ্দের ছাড়পত্রের জন্যও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (সিডিএ) আবেদন করা হয়। সিডিএতে আবেদনের ১৭ মাস পর ছাড়পত্র পাওয়া যায়। অপরদিকে অধিগ্রহণের প্রথম দফায় ৬৭ একর বরাদ্দ পায় ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে। যা ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা। এজন্য জেলা প্রশাসনকে ৩৬২ কোটি টাকা পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাকি রয়ে যায় ৮০৩ একর। সেই ৮০৩ একর ভূমি হস্তান্তরের জন্য গত বছরের জুনে ভূমি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেও জেলা প্রশাসন গত ৩০ জানুয়ারি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করে চিঠি লেখে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। আগামী ১২০ দিনের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে।
প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দ চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন,‘ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই সুবিধা পেতেই পারে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদন লাগবে। এধরনের বরাদ্দ শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকেন। তবে তারা যদি এই আবেদন আরো আগে করতো তাহলে এখনই তা হয়ে যেতে পারতো। এখন নৌ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবে এবং সেখান থেকে অনুমোদন হয়ে আসবে।’
উল্লেখ্য, হালিশহরের ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরের ভেতরের প্রায় ২৩০০ একর জায়গায় বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল কিংবা ড্রাফটের বিবেচনা কর্ণফুলী নদীর জেটিতে ভিড়লেও বে-টার্মিনালের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর জেটিতে পৌছাতে একটি জাহাজকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু বে টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে তা শূন্য কিলোমিটারের মধ্যেই বার্থিং করতে পারবে। বে টার্মিনাল নির্মাণ হলে যেকোনো দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। বিপরীতে বর্তমান চ্যানেলে মাত্র ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ কর্ণফুলীতে প্রবেশ করতে পারে। সেইক্ষেত্রেও জাহাজকে দুটি বাঁক অতিক্রম করতে হয় এবং দিনের মাত্র চার ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। কিন্তু বে টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। বিদ্যমান পোর্ট জেটিতে একসাথে ১৬টি জাহাজ বার্থিং করা গেলেও বে টার্মিনালে গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ একইসাথে বার্থিং করা যাবে। বন্দরের জেটির দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার হলেও বে টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। ল্যান্ড লর্ড পদ্ধতিতে চালু হতে যাওয়া বে টার্মিনাল চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব গোছাবে বলে বন্দর সংশ্লিষ্টদের ধারণা। কিন্ত বাস্তব অগ্রগতিতে এখনও পিছিয়ে আগামীর বন্দর বলে খ্যাত বে টার্মিনাল।