নিলা চাকমা »
এখন পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি খবর। সেই খবর পাড়ার গলির চায়ের দোকান থেকে টিভি টকশোতেও উত্তাল আলোচনার বিষয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। চলে নানামুখী সমালোচনাও। কিন্তু সমাধানের উত্তর কেউ দিতে পারে না। এটা ঠিক, প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। শুধু নিত্যপণ্যের নয়, ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাসবিল, কোথাও যেন স্বস্তি নেই। তবে এই হাহাকারের মধ্যে কিছু তরুণের উদ্যোগ আমাদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে যেন। সে রকম একটি উদ্যোগ হলো ‘ভালো কাজের হোটেল’। যেখানে খেতে টাকা লাগে না, লাগে শুধু ভালো কাজ করা। ভালো কাজ করেই এখানে পেটপুরে খাওয়া যায়।
অন্যান্য হোটেলের মতো এখানে চেয়ার-টেবিল নেই। ওয়েটার বা ক্যাশ কাউন্টারও নেই। নির্দিষ্ট সময়ে একটি খাবারভর্তি গাড়ি এসে থামে । সেই গাড়ি থেকে নামে স্বেচ্ছাসেবকেরা। কাগজ-কলম হাতে সমবেতদের উদ্দেশে তাদের জানতে চাওয়ার থাকে এ রকম : ‘আপনার নাম কী?’ ‘আপনি কি আজ কোনো ভালো কাজ করেছেন?’। তারপর খেতে আসা মানুষেরা জানায় তাদের দিনের ভালো কাজটা। এরপরই সেই ব্যক্তির কাছে তুলে দেওয়া হয় খাবার। এভাবেই চলে অসহায়- দুস্থ মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ।
‘ভালো কাজের হোটেল’ ২০০৯ সালে ৫ ডিসেম্বর ঢাকা রেলস্টেশনে যাত্রা শুরু করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র ঈদ, সরকারি ছুটিগুলোতে পথশিশু, এতিমখানা ও ভবঘুরেদের একবেলা খাওয়ানো হত। ২০১৯ সালে এসে সপ্তাহে একদিন, করোনাকাল থেকে প্রতিদিন খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকায় ৪০০ জন, চট্টগ্রামে ৫০ জন সদস্য স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। ঢাকায় এ হোটেলের ৫টি শাখা আছে। তন্মধ্যে কমলাপুর রেল স্টেশনে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯.৩০ মিনিট পর্যন্ত, সাত রাস্তার মোড়ে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত, বনানী শাখায় প্রতিদিন দুপুর ২.৩০ মিনিটি থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, খিলগাঁও শাখায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খাবার বিতরণ করা হয়। চট্টগ্রামে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খাবার বিতরণের এ কাজ চলে। ৩ মেনুতে খাবার দেয়া হয়। একবার সাদাভাত, সবজি, ডিম। পরের বার ডিম-খিচুড়ি। তারপরের বার দেয়া হয় চিকেন বিরিয়িানি। এভাবে প্রতি সপ্তাহে রাউন্ড ঘোরানো হয়।
অর্থের সংস্থান যেভাবে হয়
‘ডেইলি টেন মেম্বার’ নামে একটি ইভেন্ট খোলা হয়। সেখানে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৯০০ জন রয়েছেন। তারা প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমা দেন। প্রতিমাসে একেক মেম্বার ৩০০ টাকা করে জমা দেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিও এককালীন চাঁদা দিয়ে থাকেন। চাঁদা দানকারীরা কেউ ১ হাজার, কেউ ৫ হাজার, কেউবা আপনজনের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকীতে একদিনের পুরো টাকাও দিয়ে থাকেন। এভাবে খাবার বিতরণের কাজটি করা হয়।
‘ভালো কাজের হোটেলে’র সিনিয়র ভলান্টিয়ার মো. সাকিব হাসান বলেন, আমাদের অনেক সদস্য দীর্ঘদিন ধরে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো অর্থ নয়, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তারা। আমরা আমাদের দেশকে সুন্দর রাখতে চাই। দেশ থেকে খারাপ কাজগুলো বিতাড়িত করা আমাদের লক্ষ। আবার কাউকে যেন খাবারের কষ্টে থাকতে না হয়। আমরা চাই অসহায় মানুষের পাতে ভাত উঠুক।
‘ভালো কাজের হোটেলে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আরিফুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি হুমায়ূন আহমেদের ‘সবুজছায়া’ নামের একটি নাটক দেখেছিলাম। সেই নাটকে অভিনেতা জাহিদ হাসান প্রতিদিন অন্তত একটি ভালো কাজ করতেন। সেই ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি এবং আমার কিছু বন্ধু ২০০৯ সালে ‘ভালো কাজের হোটেল’ চালু করি। প্রথম দিকে শুধুমাত্র উৎসব-পার্বণে খাবার বিতরণ করা হতো। করোনার পর থেকে আমরা নিয়মিত খাবার বিতরণ করছি।
আমাদের হোটেলে প্রধান উদ্দেশ্য মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা। অন্য মানুষের উপকার হয় এমন কাজ করেই আমাদের হোটেলে খেতে পারেন যে কেউ। অন্ধলোককে রাস্তা পারাপারে সাহায্য করা, রাস্তায় পড়ে থাকা ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলা ইত্যাদি। যে কাজগুলোতে মানুষের উপকার হয়। যাতে করে সমাজ-দেশ থেকে খারাপ কাজ কমে আসে। ভালোবাসায় বিশ্বজয় করা।
তিনি বলেন, আমরা এখন ঢাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ২০০’র মতো লোকের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারি। কিন্ত চট্টগ্রামে কেবল সপ্তাহে একবার করতে পারি। কারণ অর্থের অভাবটা রয়েছে। যার কারণে আমরা চট্টগ্রামে কাজটা প্রতিনিয়ত করতে পারছি না। চট্টগ্রাম একটি ব্যবসায়িক রাজধানী। উচ্চবিত্তেরা এগিয়ে এলে আর চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী-তরুণেরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজে আগ্রহ দেখালে সমস্যাটি অনেকাংশই লাঘব হতে পারে। ওখানেও অসহায় মাুনেষের মুখে প্রতিদিন অন্ন উঠতো। আশা করি, চট্টগ্রামের মানুষ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন।