বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক »

প্রতিবছর রমজান এলে নিত্যপণ্যের বাজারে উত্তাপ ছড়ায়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। পাইকারি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখার আশ্বাস দেয়া হলেও নগরীর খুচরা বাজারগুলোতে তার সত্যতা মিলছে না। তাছাড়া খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা গত পনেরো দিন ধরে ইফতার সামগ্রীর উপকরণসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানো ও পর্যাপ্ত মজুদের আশ্বাস দিলেও খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব পড়েনি। ভোগ্যপণ্যেও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের অবস্থা কাহিল।

গতকাল নগরীর খাতুনগঞ্জ, বক্সিরহাট, রেয়াজউদ্দিন বাজার ও কাজির দেউড়ি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রমজানের ইফতার সামগ্রীসহ চিনি, আটা, ময়দা, ছোলা, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, মাছ, মাংস ও ডিমের দাম অনেক বেড়েছে। তাছাড়া সবজির মধ্যে শীতকালীন সবজির দাম কিছুটা কমতি থাকলেও বেগুন, শসা, গাজর ও কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা। তাছাড়া অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে লেবুর। বাজারে লেবু ডজনপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ও খুচরা বাজারে মরিচের দাম আবারো চড়া। গত বছর এই সময়ে খুচরা বাজারে দেশি শুকনো মরিচ কিনতে ক্রেতাদের খরচ হতো কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ২০০ টাকা। এখন সেই মরিচ কিনতে হচ্ছে ৩৯০ থেকে ৪৩০ টাকা কেজিতে। ভারত থেকে আমদানি করা মরিচ কেজিপ্রতি ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকার উপরে। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে দেশি শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২১ শতাংশের উপরে। আর আমদানি করা শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩৬ শতাংশ।
গত বছর এ দিনে চিনির কেজি ছিলো ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ৫১ শতাংশ বেড়ে এবছর রোজায় চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। বছরের মাথায় চিনির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।

অন্যদিকে রমজানকে কেন্দ্র করে সকল ধরনের মাংসের দাম আরেক দফা বেড়েছে। গতকাল বক্সিরহাট ও কাজির দেউড়ি বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা। নিম্নবিত্তের প্রাণিজ আমিষের এই বড় উৎসটি এখন সাধারণ মানুষের নাগালছাড়া। যা এক বছরের ব্যবধানে ৬২ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া ব্রয়লারের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সোনালি ও দেশি মুরগির দামও। গতকাল সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৪০০ টাকা ও দেশি সাড়ে ৬৫০ টাকা।

অন্যদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি আরো ৫০ টাকা। গতকাল বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকা। যা এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৬ শতাংশের উপরে। এক বছর আগে এ সময়ে গরুর মাংস বিক্রি হতো ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। খাসির মাংসের দাম ছাড়িয়েছে ১২০০ টাকা।

বক্সিরহাটে মাংস কিনতে আসা মো. আসাদুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগি ও গরুর মাংসের দাম আবার বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আজ সাড়ে ৯০০ টাকা করে গরুর মাংস কিনলাম।

বক্সিরহাটের শাহ আমানত মাংস দোকানের বিক্রেতা বলেন, বাজারে গরুর দাম বেড়ে গেছে। ফলে ক্রয়মূল্যের সাথে সমন্বয় করে মাংস বিক্রি করছি। আজকে হাড্ডি ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে ৯০০ টাকা। কিছু করার নেই।

একই অবস্থা ডিমের বাজারেও। বক্সিরহাটে ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। গতবছরের তুলনায় এ বছর ডিমের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশের উপরে। তাছাড়া আটা, ময়দা, রসুন, মরিচ গুঁড়া ও হলুদ গুঁড়ার একই অবস্থা।

ইফতারের অন্যতম উপকরণ খেজুর। সেটাও বলা যায় নাগালের বাইরে। গতকাল বাজারে সাধারণ মানের খেজুর বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর আজওয়া, মরিয়ম, মাকবুর প্রভৃতি খেজুরের দাম কেজি ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা।

ইফতারের আরেক উপকরণ ছোলা। অন্যবারের তুলনায় এবার খাতুনগঞ্জে পর্যাপ্ত পরিমাণ ছোলা আমদানি ও মজুদ হয়েছে। ফলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বারবার ছোলার দাম কম থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব পড়েনি। গতকাল বক্সিরহাট ও রেয়াজউদ্দিন বাজারে কেজিপ্রতি ছোলা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। যা গত বছরের তুলনায় এবছর বেড়েছে ১৭ শতাংশের উপরে।

রেয়াজউদ্দিন বাজারে রমজানের বাজার করতে আসা মো. সানোয়ার নামক এক ব্যাংক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়াবে না বলে, তা শুধু খবরে দেখি, বাস্তবে বাজারের চিত্র তার উল্টো। রমজানকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী মানুষকে জিম্মি করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে মনিটরিং না থাকায় এসব ব্যবসায়ী তার সুযোগ নিচ্ছে।

একই বাজারের মুদির দোকানদার সালাম ট্রেডার্সের ম্যানেজার আবুল হোসেন বলেন, প্রতিবছর রমজানে ছোলার দাম বেড়ে যাওয়ায় এবছর আরো বাড়বে বলে মনে করে কিছু মজুদ করছিলাম। তা আমাদের বেশি দামে কিনতে হয়েছে। তাই খরচের সাথে সমন্বয় করে ছোলা বিক্রি করছি।

মাছের দামেও উত্তাপ। গত বছর ছোট পাঙাশ মাছ ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় কেজি পাওয়া গেলেও তা এখন কিনতে হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়।

গতকাল রেয়াজউদ্দিন বাজার দেখা যায়, এক কেজি বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি ওজনের পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। মাঝারি আকারের তেলাপিয়া কেজিপ্রতি ২০০ টাকা। চাষের কৈ মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, ছোট বোয়াল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ছোট টেংরা ৪০০ টাকা, টার্কি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, সাইজ আকারে রুই মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, কাতলা ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, শিং মাছ ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, রূপচাঁদা মাঝারি সাইজের প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সাহ্রি খাওয়ার পর আজ শুক্রবার থেকে রোজা শুরু হয়েছে। বাজারে ইতোমধ্যে রোজার কেনাবেচা শুরু হলেও বাজারে আগের মত তেমন বেচাকেনা কম বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এর প্রধান কারণ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা কমেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।