সুপ্রভাত ডেস্ক »
সারা দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলের এখন করুণ অবস্থা। প্রথমত বছরের পর বছর বিনিয়োগের অভাবে জরাজীর্ণ অবকাঠামো, সেই সঙ্গে ভালো চলচ্চিত্রের অভাব এবং তারপরই করোনাভাইরাস মহামারি। সবমিলিয়ে সিনেমা হলগুলোর করুণ অবস্থা এখন প্রায় ‘বিলুপ্তির’ কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে।
তবে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় মাল্টিপ্লেক্সে। সেখানে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিনিয়োগ।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে স্টার সিনেপ্লেক্স। এটিই দেশের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স।
সে সময় তাদের বিনিয়োগ ছিল ৫ কোটি টাকা। তখন এর কর্মী ছিল ৪০ জন।
স্টার সিনেপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ২০২১ সালে এর বিনিয়োগ ১২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর কর্মীর সংখ্যা বেড়ে এখন ৪০০ জনেরও বেশি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি রুচি বোধের পরিবর্তনের কারণে দেশের সিনেমার দর্শকের কাছে মাল্টিপ্লেক্সের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
তাদের মতে, দর্শকরা সুন্দর ও আরামদায়ক পরিবেশে সিনেমা দেখতে চায়। তাই মাল্টিপ্লেক্স দিন দিন সিনেমা প্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান রুহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের সিঙ্গেল স্ক্রিনের মালিকেরা টেকনোলজি চেঞ্জের সঙ্গে এডাপ্ট করতে পারেনি। যার কারণেই তাদের এই দুরাবস্থা। তারা পিছিয়ে পড়েছে।’
সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মল ছাড়াও ঢাকার ধানমন্ডি, মিরপুর ও মহাখালীতে তাদের শাখা আছে।
বসুন্ধরায় সিনেপ্লেক্সের ৬টি হল আছে এবং সেখানে ১ হাজার ৬০০ দর্শক সিনেমা দেখতে পারেন। ধানমন্ডির সীমান্ত সম্ভারের ৩টি হলে ৭০০ দর্শক সিনেমা দেখতে পারেন। মহাখালীর এসকেএস টাওয়ারে ৩টি হলে ৫০০ জন এবং মিরপুরের সনি স্কয়ার মলের ৩টি হলে ৭৬৯ জন সিনেমা দেখতে পারেন।
রুহেল বলেন, ‘প্রথম দুটো বছর বেশ কষ্ট করেছি। দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তবে আশা হারাইনি। ভেবেছি বাংলাদেশ ভালো ছবি বানাবে। আর আমরা হলিউডের ওপর নির্ভরশীল হব।’
বসুন্ধরা শপিং মলে ৩টি প্রেক্ষাগৃহ দিয়ে যাত্রা শুরু করে স্টার সিনেপ্লেক্স। প্রথম ২ বছর ক্ষতি গুণতে হলেও, হলিউডের গ্ল্যাডিয়েটর ও বাংলাদেশের মোল্লা বাড়ির বউ সিনেমা দুটি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সিনেপ্লেক্স।
প্রতিষ্ঠানটি এখন হলিউডের সঙ্গে মিলিয়ে একই দিনে ছবি মুক্তি দেয়।
সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান রুহেল জানান, তারা গড়ে প্রতি মাসে ২টি সিনেমা মুক্তি দেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা করেছি ওই সময় লেটেস্ট প্রযুক্তি এনে দেশে ব্যবসা শুরু করেছি। টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভানটেজটা পেয়েছি।’
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল
প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে দেশে ১ হাজার ২৩৫টির মতো সিনেমা হল ছিল। দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে সচল আছে ৬০টির মতো হল।
তবে ঈদের সময় এই সংখ্যা বেড়ে কখনও কখনও ১২০টি হয় বলে সমিতি জানায়।
সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। যার কারণে এই খাতে বিনিয়োগ করে লসের মুখ দেখেছি।’
‘বেশির ভাগ এলাকায় হলের মালিকেরা ভবনগুলো ভেঙে ফেলে সেখানে বহুতল বিপণি বিতান গড়ে তুলছেন,’ যোগ করেন তিনি।
আলাউদ্দিন বলেন, ‘দেশের এখন অনেক জেলা এমনকি বিভাগীয় শহর আছে, যেখানে একটিও সিনেমা হল নেই। গত ১০ বছরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৮০ শতাংশ কর্মী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
এদিকে দেশে এখন হলিউডের সিনেমা মুক্তি পেলেও, প্রতি বছরই কমছে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশীয় সিনেমার সংখ্যা।
সেন্সর বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেশে বিদেশি ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পেয়েছে ৩২৮টি। একই সময়ে দেশি সিনেমা ছাড়পত্র পেয়েছে যথাক্রমে ৩২১টি।
এ প্রসঙ্গে সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান রুহেল বলেন, ‘দেশের প্রযোজক-পরিচালকদের বুঝতে হবে দর্শক এখন কী ধরনের ছবি পছন্দ করেন। বাংলাদেশে উপমহাদেশের ছবি প্রদর্শনের বেলাতে যে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেটি তুলে নিতে হবে।’
‘দর্শক তামিল ও তেলেগু ছবি কোনো না কোনোভাবে দেখছে। আল্টিমেটলি আমরা রেভিনিউ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি,’ যোগ করেন তিনি।
বেড়ে যাচ্ছে মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা
চট্টগ্রামে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে যাত্রা শুরু করে সিলভার স্ক্রিন। চট্টগ্রামের প্রথম সিনেপ্লেক্স এটি।
সিলভার স্ক্রিনের অন্যতম অংশীদার ফারুক আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আছে আরেকটি সিনেপ্লেক্স করার। কিন্তু কোভিডের কারণে তা থেমে আছে।’
‘সরকারও এই সেক্টরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দিয়ে রেখেছে,’ বলেন তিনি।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘যদি আপনি ১০০ আসনের একটি সিনেপ্লেক্স করতে চান, তাহলে ৩-৪ কোটি টাকার একটা বিনিয়োগ করতে হয়।’
তবে অনেক কিছুর দাম বেড়ে গিয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এখন তা করতে গেলে ৫-৮ কোটি টাকা লাগবে।
২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে যাত্রা শুরু করে যমুনা গ্রুপের ব্যয়বহুল ‘ব্লকবাস্টার সিনেমাস’।
ব্লকবাস্টারের হেড অব অপারেশন জাহিদ হোসেন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের আধুনিক প্রযুক্তির ৭টি সিনেমা হল আছে। এগুলোর মোট আসন সংখ্যা ১ হাজার ৮৮০টি। তাদের মোট কর্মীর সংখ্যা ৭৫ জন।
তিনি জানান, এই খাতে তাদের ভবিষ্যতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে।
স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশব্যাপী তাদের ১০০টি স্ক্রিন চালুর পরিকল্পনা আছে।
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার নবাব সিরাজুদ্দিন রোডের বালি আর্কেড শপিং কমপ্লেক্সে স্টার সিনেপ্লেক্স তাদের নতুন শাখা চালু করতে যাচ্ছে।
বগুড়ার নবাব বাড়ি রোডের সাতমাথা মোড়ে অবস্থিত পুলিশ প্লাজায় সিনেপ্লেক্সের নতুন শাখা চালু করার বিষয়ে গত ৩ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে।
এছাড়া, রাজশাহীতেও সিনেপ্লেক্সের নতুন শাখা চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র : ডেইলি স্টার