সুপ্রভাত ডেস্ক
বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনে ৬,২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ৯টি বিদেশি কোম্পানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ দেশে কৃষি আধুনিকায়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে প্রস্তাব দিয়ে, সংস্থাটির সম্মতির পর রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি)- এর কাছে শাখা পরিচালনার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে।
আরজেএসসি সূত্রে জানা গেছে, চারটি চীনা কোম্পানি যথাক্রমে ৭০০ কোটি টাকা; ১,২০০ কোটি টাকা; ১,০০০ কোটি টাকা এবং ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক।
জাপানের দুটি কোম্পানি ৮০০ কোটি টাকা এবং ৩৫০ কোটি টাকা এবং দুই কোরিয়ান কোম্পানি ৫৫০ কোটি ও ৬৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। এছাড়া, তাইওয়ানের একটি কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চায় ৪০০ কোটি টাকা। খবর টিবিএস।
আরজেএসসি অফিসের রেজিস্ট্রার শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, এসব বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন পরিচালনার জন্য এ বছরের বিভিন্ন সময়ে আবেদন করেছে। সেই আবেদনগুলো পর্যালোচনা করছে আরজেএসসি। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এসবের অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে সেক্ষেত্রে একটু সময় প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
‘বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নের ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়,’ বলেন শোয়েবুল আলম।
৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চীনা কোম্পানি জুহাচুন লিমিটেড প্রাথিমিকভাবে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত ফয়সাল শহীদ সুমন টিবিএসকে জানান, কোম্পানিটি প্রায় ৮ ধরনের কৃষিযন্ত্র ও এসব যন্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরি করে।
ঢাকার কাছাকাছি একটি ইকোনোমিক জোনে তিন একর জায়গা চেয়েছে কোম্পানিটি। সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আগামী বছরের শুরুর দিকে কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু হবে এবং একই বছরের শেষের দিকে বা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে। উৎপাদন কারখানা চালু হলে এতে প্রায় ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে জানান তিনি। ফয়সাল আরও জানান, প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ উৎপাদনের পর শুধু বাংলাদেশেই তা সরবরাহ করবে না; ভরত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, নেপাল, শ্রীলংঙ্কাসহ আরও ৭টি দেশে এসব যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম যেমন- কৃষি যানবাহন, ট্রাক্টর, কম্বাইন হার্ভেস্টার, ট্রাক্টর এটাচমেন্টস, লাঙ্গল, হ্যারো, ফার্টিলাইজার স্প্রেডার, সিডার, বেলার এবং ওয়াগন ট্রেলারও তৈরি করবে এই কোম্পানি। আরজেএসসি’র একটি সূত্র জানিয়েছে ৯ কোম্পানির মধ্যে ৮টিই বাংলাদেশে যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন দেশে রপ্তানির কথা উল্লেখ করেছে তাদের আবেদনে। বিডা সূত্রে জানা গেছে, এসব কোম্পানির মধ্যে ৫টিই বিভিন্ন ইকোনোমিক জোনে কারখানা স্থাপনের জন্য জায়গা বরাদ্দ চেয়েছে। আর বাকি ৪টি রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় কারখানা তৈরি করতে চায়। যদিও এখনি কোম্পানিগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে রাজি হয়নি সূত্র।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বার্ষিক বাজার প্রায় ১১,০০০ কোটি টাকা। দেশে কৃষিকাজে যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে, তার বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বিদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের ১১,০০০ কোটি টাকার প্রায় পুরো বাজারটিই বিদেশিদের দখলে। যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ এতো বড় অঙ্কের টাকা চলে যাওয়ার কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। তবে কিছু স্থানীয় কোম্পানিও স্বল্প পরিসরে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি খন্দকার মঈনুর রহমান বলেন, কৃষি যন্তপাতি ও যন্ত্রাংশ উৎপদনে দেশে বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগের খবর অবশ্যই ভালো। তবে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে এটি দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ হবে না।
তিনি আরও বলেন, দেশে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ভালোমানের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারে। সরকারের উচিত তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। বিডার নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন বলেন, কিছু বিদেশি কোম্পানি কৃষিযন্ত্র উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করতে চায়। বিডার পক্ষ থেকে তাদেরকে সার্বিক সহযোগীতা করা হচ্ছে।
বিডার আরও একজন কর্মকর্তা বলেন, এই ৯ কোম্পানি দেশে কারখানা নির্মাণের পর উৎপাদনে গেলে, কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার পাশাপাশি ৮ থেকে ১০ হাজার লোকের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ৯৫ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে।’
এরমধ্যে বালাইনাশক ব্যবহারে ৯০ ভাগ এবং ফসল মাড়াইয়ে ৭৫ ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ, যেসব যন্ত্রপাতির দাম কম, সেসব যন্ত্রের ব্যবহার বেশি। সার প্রয়োগে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ৩ ভাগ, চারা রোপণে ১ ভাগ, ফসল কাটায় ১ ভাগ; আর এগুলোর বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি যেমন- জমি চাষ ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের শতকরা ৯৫ ভাগ, ফসল কাটার যন্ত্র- রিপার ৯৯ ভাগ, চারা রোপণ যন্ত্র ১০০ ভাগ, কম্বাইন হার্ভেস্টার ১০০ ভাগ ও বীজপণ যন্ত্র ৭০ ভাগ আমদানি করতে হয়। শুধু মাড়াই কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র থ্রেসার মেশিন ১০০ ভাগ দেশে তৈরি হয়। এমএ সাত্তার মণ্ডল জোর দিয়ে বলেন, ‘দেশে এসব যন্ত্র উৎপাদিত হলে দেশের কৃষি অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে। কারণ, বিদেশি মেশিনগুলো এখন যে দামে কেনা হয়, দেশে উৎপাদন হলে এর চেয়ে কম দামে কেনা যাবে। তখন ট্যাক্স ভ্যাট অনেকটাই কমে আসবে।’ এছাড়াও সরকারের রাজস্ব আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও উল্লেখ করেন এই কৃষি অর্থনীতিবিদ।