হাফিজ রশিদ খান :<<
বিজয়ের শেষে নিজস্ব রাষ্ট্রনির্মাণের অনুভ‚তিতে ঋদ্ধ বাঙালি জাতি উনপঞ্চাশ বছর পূর্ণ করলো আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২০। এই প্রায় পাঁচ দশক সময়ে এদেশবাসী নিজেদের রক্তঘামের বিনিময়ে বহু নবনির্মাণের সৌধ গড়েছে তলে-তলে। বুকে বেদনার মহাসাগর পুষে রেখেই তার এই নির্মাণ, এই পথচলা। রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজের বিবর্তনের ধাপে-ধাপে সেই নবনির্মাণের বহু চিহ্নই অনায়াসে শনাক্ত করা চলে এখন। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম সাফল্যের দৃশ্যপটটি নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার শুরু এবং তার একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রসঙ্গ। যা সবিশেষ উল্লেখযোগ্যতার নিরিখি দাবি করে। মানবতাবিরোধী তথা যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রথম রায়টি কার্যকর হয় ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে। এই রায় কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অস্তিত্বের পথে কাঁটাস্বরূপ বাধাগুলোর একটিকে অত্যন্ত সফলভাবে তুলে নিয়ে খুব দূরে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে সাবলীলভাবে।
অর্থনৈতিক চাকার সচলতায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দৃশ্যমানতা আজ আর কোনো গালগল্প নয়, অতি উজ্জ্বল বাস্তবতা তা। আর এ দেশের সন্তানদের আয়ের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বহু অসাধ্যকে সাধন করেছে, সে তো বহুকথিত আনন্দময় রূপকথা। আরেকটি হচ্ছে পদ্মা সেতুর মূলকাজের পরিসমাপ্তি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বেড়ে ওঠা সময়ে দেখা হরতাল-অবরোধ, ভাঙচুরের অপসংস্কৃতির সর্বসম্মত বিদায় তথা পশ্চাদপসরণ জাতীয় অর্থনীতির মেরুদÐে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তির যোগান দিয়েছে, খুব দৃঢ়তার সাথেই তা বলা যায়। জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনায় এটিকে এদেশের ঘাড়ে চেপে বসা সিন্দাবাদ নামীয় ভ‚তটির বেঘোরে মৃত্যুবরণ করা বললে মন্দ শোনাবে না। আর সাংস্কৃতিক ও মননজগতে নতুন উদ্দীপনার ঢেউ লেগেছে পোস্টমডার্ন ছাঁচে মসৃণ পারিপাট্যের সমতালে লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি নাগরিক সমাজের চুম্বকীয় আকর্ষণে। কবিতায় নাটকে কথাসাহিত্যে শিল্পকলায়, মায় পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে স্থাপত্য ও চারুশিল্পে পোস্টমডার্ন চিন্তনের ছোঁয় লেগে চলেছে খুব সূ² ও চারুভঙ্গিতে। সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতিতেও তার খুব ছুঁচালো অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সংবেদের বাতায়ন একটু মুক্ত করলেই যা বোধগম্য হয় পরিচ্ছন্নভাবে। তৃণমূলের ধর্মীয় সভা-সংঘের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বোঝাপড়ায় এর একটি তীব্র-তীক্ষè ইংগিত রয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধের কালিমালিপ্ত ধর্মীয় রাজনীতির বাহিরানা অন্য ডানাকে বিবেচনায় রেখে এ রাজনৈতিক অভিক্ষেপ সময়ের নতুন দ্যোতনাকে বিস্তার দিয়েছে, সন্দেহ নেই। মনে পড়ে, নব্বই দশকের মাঝপর্বে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এক আড্ডায় একজন তরুণকবির মৌলবাদ বিষয়ে শংকাকুল প্রশ্নের জবাবে সহাস্যে বলেছিলেন, যে-দেশের প্রধান ধর্মীয় আলেম-ওলামারা এ মাটিরই সন্তান আর ধলপ্রহরে হাতজাল নিয়ে বিল-হাওর থেকে ধরা মৌরলার ঝোলে দুটো খেয়ে মসজিদ মক্তব মাদ্রাসায় ছুটে ওদের নিয়ে অতটা বিচলিত হবার কিছু নেই। কথাটা খুব ভাবিয়েছিল আমাকে। আজ মনে হয়, তাঁর কথার সারবত্তাটি ফলদায়ী বৃক্ষ হয়ে উঠেছে যেন। যদিও বিতর্কের ডালপালাও সেই সঙ্গে কম থাকছে না। চিরদিন বিতর্ক করে সুখ পাওয়া মানুষেরা কোনো সমাজ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যায় না একেবারে। আবার অন্য এক বিবেচনায় নিরিখে ভাবা যায়, এসব ইতিবাচক বিষয়-আশয় আমাদের বিজয়-অভীপ্সার ভেতরেই সযতœ শায়িত ছিল কিনা। বহুদিন এদেশ, এ জাতি একটি জটপাকানো অন্ধতার ভেতর কেবলি নাগ-নাগিনীর ফোঁসফাঁসে মৃত্যু আর শোক, বিলাপ আর বিকারে ন্যুব্জ ছিল। বিচিত্র-বিবিধি তন্ত্রমন্ত্রের জটাজালে হাঁসফাঁসে ছিল দেশের কোটি-কোটি সোনার সন্তানেরা। কে গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, কে বা কারা বহুত্ববাদী দর্শনের মালাকার, কিংবা কারা ষড়যন্ত্রী, বাঁকাচোরা কালোকালের জালে কেবলি শিকারি, আজ তা অনেকটাই খোলাসা হয়ে উঠেছে দিবাকরের আলোর মতো।
আজকের বিজয় দিবস উদযাপনের এই প্রস্তুতি ও প্রয়োজনের মুহ‚র্তে আমাদের নিজেদের দিকে এভাবেই তাকাতে হবে আরও গাঢ় নিজস্ব নয়নের আলোয়। কারণ, এই বিজয় আলাদীনের চেরাগ হয়ে আমাদের দোরে আলো ছড়িয়ে যায়নি। আমরা হাত বাড়ালাম আর তালুতে ঝুপ করে এ বিজয় এসে পড়লো, এ নয় ইতিহাস। সেই সাতচল্লিশের ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ গণআত্মার চিৎকার, ধিক্কার, ক্রন্দন আর ফুঁসে-ওঠার রক্তাক্ত ধারাবাহিকতার পথবেয়ে উনিশ শো একাত্তর এসেছে। আর একাত্তর মানেই রক্ত দিয়ে লেখা বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের সকল প্রান্তের মানুষের নাম। পাহাড়ে যারা, অরণ্যে যারা, সমতলের কুঁড়েঘরে যারা। একাত্তরে যুদ্ধের যে-নাকাড়া বাজতে শুনেছি উপরিতলে অস্ত্র আর রক্তের ঝনঝনানিতে, তার ভেতরের লয়েই তো ছিল বিজয়ের নিবিড় বীণের তান। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিভিন্ন রণাঙ্গনে হায়েনা পাকিসেনাদের পরাজয়ের তপ্ত সংবাদে ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সাধনার পরিসমাপ্তির পদধ্বনি। এ বিজয় মানে ছিনিয়ে আনা প্রভাতসূর্যের গান। এ বিজয় মানে বাহান্নের একুশের সোপান বেয়ে আগত গগনবিদারী বজ্রনিনাদ সমূহের ক্রমে শমিত হয়ে ঘরে ফেরার ঘাম। চুয়ান্নের প্রবল ধারাবর্ষণ। চৌষট্টির সলতে পাকানো, ছেষট্টির ছয়দফা মহাসনদের বীজক্ষেত্র। উনসত্তরের পাগলা প্রতিরোধ। সত্তরে নিরংকুশ গণরায়ে দুর্গনির্মাণ আর একাত্তরে ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ …। আর সেই প্রেরণায় সম্মিলিত মুক্তিফৌজের অগ্রগমণ। এভাবে উল্লাস আর ক্রলিং, বিজয় আর স্বদেশনির্মাণের প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা। একটি দেশের অস্তিত্ব, তার আমজনতার ভালোবাসা।
এভাবেই, ঠিক এখানেই এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ এখন। তবে তা মোটেও থেমে থাকার জন্যে নয়। বরং আরো আগুয়ান হতে, মুকুটে আরো সোনার পালক গুঁজবে বলে। এই সোনায় মোড়ানো বাংলাদেশই আমাদের আরাধ্য। এর মিনারে, এর বেদিতলে আমরা অর্পণ করেছি হৃদয়ের পুষ্পার্ঘ। কোনো কাপালিক, হরণকারী কোনো প্রেতাত্মা এখানে পাবে না পা রাখার ঘাট।
আমরা বিজয়ী। বাংলাদেশ আমাদেরই, মানে বাংলাদেশের জনগণেরই একচ্ছত্র রাজ্যপাট। কারণ, ‘বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙাল এই দেশেরই জীয়ন কাঠি …