সুপ্রভাত ডেস্ক »
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর যিনি সবার আগে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের কাছে, সেই বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সায়মন ড্রিং মারা গেছেন।
গত শুক্রবার রোমানিয়ার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় সায়মন ড্রিংয়ের মৃত্যু হয় বলে তার আত্মীয় ক্রিস বার্লাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
রয়টার্স, টেলিগ্রাফ ও বিবিসির হয়ে সাইমন ড্রিং দীর্ঘদিন কাজ করেছে বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
চলতি শতকের গোড়ায় বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন স্টেশন একুশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর সময় সাইমন ড্রিংয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, তার হাত ধরে এ দেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতা নতুন মাত্রা পায়।
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই ব্রিটিশ সাংবাদিককে ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায় ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বার্তায় বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিকাশে ও দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির পরিচালনাতেও তার অবদান রয়েছে।”
১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের নরফোকে জন্ম নেওয়া সায়মন ড্রিং সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহতও হয়েছেন একাধিকবার।
তার স্ত্রী ফিয়োনা ম্যাকফারসন একজন আইনজীবী এবং রোমানিয়াভিত্তিক একটি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। ইভা ও ইনডিয়া তাদের যমজ মেয়ে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তানিয়া নামে আরও একটি মেয়ে রেখে গেছেন সায়মন ড্রিং
তার কাজিন ক্রিস বার্লাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সায়মনের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। গত কিছুদিন ধরে তিনি হার্নিয়ার সমস্যায় ভুগছিলেন, সে কারণেই রোমানিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
“সেখানে অস্ত্রোপচারের সময় তার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তাররা তাকে আর বাঁচাতে পারেননি।”
দুনিয়াজোড়া কর্মক্ষেত্র
বিশ্বভ্রমণের নেশায় ১৯৬২ সালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন সায়মন ড্রিং, তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর, পড়ছিলেন কিংস লিন টেকনিক্যাল কলেজে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং ভারতেও সে সময় তার পা পড়ে।
১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে ফিচার রাইটার হিসেবে সায়মন ড্রিংয়ের সাংবাদিকতার শুরু। পরে লাওস থেকে যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য তিনি ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু করেন।
রয়টার্সের হয়ে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে ১৯৬৪ সালে তিনি চলে যান ভিয়েতনামে। তিনিই তখন রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা।
এরপর ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এরর দশক জুড়ে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন, বিবিসি রেডিও, সানডে টাইমস, নিউজইউকের হয়ে কাজ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য আর লাতিন আমেরিকার বহু দেশ তিনি সে সময় চষে বেড়িয়েছেন খবরের পেছনে।
ইরানের শাহবিরোধী বিপ্লবের সময় সায়মন ড্রিংয়ের বিভিন্ন প্রতিবেদন দারুণ সাড়া জাগায়, সেজন্য বিভিন্ন পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। সেই বিপ্লবে রেজা শাহ পাহলভী ক্ষমতাচ্যুত জলে যে বিমানে করে আয়াতুল্লাহ খোমেনি প্যারিস থেকে তেহরানে পৌঁছেছিলেন, সেই বিমানে সায়মন ড্রিংও ছিলেন।
উগান্ডায় ইদি আমিনের সময় মৃত্যুদণ্ডের হুমকিও পেতে হয়েছিল এই ব্রিটিশ সাংবাদিককে। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের কাজেও নিজেকে যুক্ত করেছেন তিনি।
সায়মন ড্রিং ৪৭ বছর বয়সে বিবিসি রেডিও ফোরের ‘অন দ্য রোড এগেইন’ শিরোনামে একটি সিরিজের জন্য তার কৈশোরের সফরের পথ ধরে আবারও বেরিয়ে পড়েন ১৮ হাজার মাইলের দীর্ঘ ভ্রমণে। পরে ১৯৯৪ সালে সেই ভ্রমণ নিয়ে একই নামে আট পর্বের ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন, যা বিবিসি টেলিভিশন এবং ডিসকভারিতে প্রচার করা হয়।
১৯৯৫ সালে ‘অন দ্য রোড এগেইন: থার্টি ইয়ার্স অন দ্য ট্র্যাভেলার্স ট্রেইল টু ইন্ডিয়া’ নামে একটি বইও লেখেন ড্রিং, যা প্রকাশ করে বিবিসি বুকস।
একাত্তরের গল্প
১৯৭১ সালের শুরুর দিকে সায়মন ড্রিং ডেইলি টেলিগ্রাফের হয়ে কাজ করছিলেন কম্বোডিয়ায়। মার্চে লন্ডনের হেড অফিস থেকে তাকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে বলা হল, কারণ ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত, সম্ভবত বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
সেই খবর সংগ্রহ করতে ৬ মার্চ ঢাকায় নামেন সায়মন ড্রিং। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণও তিনি প্রত্যক্ষ করেন।
বাংলা না জানায় সেই ভাষণের বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে না বুঝলেও লাখো জনতার চোখের ভাষায় তিনি ঠিকই বুছেছিলেন, সত্যিই বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
সায়মন ড্রিং ঢাকায় এসেছিলেন সপ্তাহখানেকের সময় নিয়ে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তিনি থেকে গেলেন। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে পরিচয় হল। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির খবর তিনি নিয়মিত পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।
২৫মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় অর্ধশত বিদেশি সাংবাদিককে আটকে ফেলে তখনকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে । পরদিন তাদের হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে গণহত্যার কোনো খবর সংগ্রহ করতে না পারে বিশ্ব গণমাধ্যম।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ঢাকায় এসে সায়মন ড্রিং আবারও তার স্মৃতিময় স্থানগুলো ঘুরে দেখেন, যা নিয়ে সে সময় একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি হয়।
সায়মন ড্রিং ওই হোটেলেই ছিলেন। পাকিস্তানিদের নির্দেশ না মেনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি লুকিয়ে পড়েন। শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘণ্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেনের মত জায়গায়।
২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সায়মন ড্রিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘুরে দেখেন। পরে অক্ষত অবস্থায় সবগুলো নোটবুক সঙ্গে নিয়ে থাইল্যান্ডে চলে যান।
ধ্বংসযজ্ঞের সেই প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে ধরে ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। সেটাই ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পাকিস্তানি গণহত্যার প্রথম বিবরণ।
তিনি লিখেছিলেন, “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সন্ত্রস্ত নগর।”
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর লন্ডনে ফিরে গেলেও ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জেনে আবার তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনও তিনি ঢাকায় ছিলেন।
২০১২ সালে সোনারগাঁও হোটেলে স্মৃতি ৭১ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানে সেইসব দিনের গল্প শুনিয়েছিলেন সায়মন ড্রিং। বলেছিলেন, ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার দরকার।
সেই অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি, যিনি একাত্তরে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন। তাদের দুজনকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায় ভূষিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশ পর্ব
সাইমন ড্রিং আবার বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৭ সালে। এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ার প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি।
একুশে টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে অর্ধশতাধিক সাংবাদিক, প্রযোজক এবং সম্পাদক নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। আর তার সুবাদেই পাল্টে গিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের টেলিভিশন সংবাদ দেখার অভিজ্ঞতা। অল্প সময়ের মধ্যে একুশে টেলিভিশন পৌঁছে যায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় একুশে টেলিভিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যম হিসেবে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান ক্ষমতাসীন দলের পছন্দ হয়নি।
পরের বছর অক্টোবরে তখনকার খালেদা জিয়ার প্রশাসন সায়মন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করে।
চলে যাওয়ার আগে এক বিদায় অনুষ্ঠানে দেশের সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সামনে সায়মন ড্রিং বলেছিলেন, এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত তাকে বাংলাদেশ থেকে ‘বের করে’ দেওয়া হল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্মননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ২০১২ সালের মার্চে আবার বাংলাদেশ আসেন সায়মন ড্রিং। পরে তিনি কিছুদিন যমুনা টেলিভিশনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম