সুভাষ দে »
সারা দেশে বনদখলদারদের তালিকা করেছে বনবিভাগ। বনবিভাগ এই তালিকা দিয়েছে বন পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে। বনবিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাদেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি অবৈধ দখলে আছে আর বনভূমি ও বনাঞ্চলের জবরদখলকারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। বনবিভাগের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কক্সবাজারে। এই জেলায় মোট দখল হওয়া বনভূমির পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪৭১ একর। (সূত্র : জনকণ্ঠ ২১ মার্চ/২০২১)
ঐ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বনভূমির আয়তন প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর যা মোট ভূখ-ের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। (সূত্র-ঐ)
অথচ পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে ভূ-খ-ের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। মানুষের জীবন-জীবিকা আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য, অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্যই বনভূমি ও বনাঞ্চল, অরণ্যানী থাকা প্রয়োজন, সেই অনুপাতে আমাদের বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। ফলে আমরা যে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে রয়েছি তা বলাই বাহুল্য। আর ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবহাওয়ার উষ্ণায়ন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত মরুকরণ, বিভিন্ন প্রকার পরিবেশ দূষণের চিত্র বলে দেয় আমরা আমাদের অদূরদর্শী ও অসচেতন কর্মকা-ে বন-বনাঞ্চল বিনাশ করে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি নিয়ে আসছি।
দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বনভূমি ধ্বংসের কারণে বায়ুর মান গত ৩ বছরে বেশি খারাপ হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে বায়ুর মান কখনোই স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পাওয়া যায় না। বায়ুদূষণজনিত নানা রোগের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। আর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে নিয়মিত বন, বনাঞ্চল, বৃক্ষ উজাড়।
গত ২১ মার্চ পালিত হয়েছে বিশ্ব বন দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবার বন দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বন পুনরুদ্ধার, উত্তরণ ও কল্যাণের পথ’। আমাদের দেশে বনভূমি উজাড়ের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী, বিত্তশালীদের লোভ, ভোগলিপ্সা ও মুনাফা। বনরক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাÑকর্মচারীদের দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য দায়ী। পরিবেশের জন্য হুমকি জেনেও বিপুল পরিমাণ বনভূমি সরকারিÑ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেক সময় বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও বনভূমি, বনাঞ্চল লিজ দেওয়ার সুপারিশ করেন, তাদের আগ্রাসী মনোভাবে দখল প্রক্রিয়া বিস্তৃত হয়েছে। এ ধরণের প্রক্রিয়া বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি দখলে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি উজাড় করতে প্ররোচনা দেয়। পার্বত্যাঞ্চলে কাঠের পারমিট এ ধরণের একটি নজির। পারমিটধারীরা অনুমোদনের বাইরেও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহ করে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে কাঠবাহী ট্রাক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাচ্ছে বিনা বাধায়। শুধু পার্বত্য এলাকা নয়, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা, রাজশাহী অঞ্চলের নিবিড় বনাঞ্চলও দিন দিন উজাড় হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের ২১ মার্চের নিবন্ধে বলা হয়েছে তৎকালীন পুন্ড্রবর্দ্ধন বর্তমান বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর বরেন্দ্র অঞ্চল, সমতট অঞ্চল, বৃহত্তর যশোর, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চল গভীর বন ও বন্যপ্রাণিতে পরিপূর্ণ ছিল। আইন-ই-আকবরীতে (আবুল ফজল প্রণীত) কুষ্টিয়া ও যশোর পর্যন্ত সুন্দরবনের বিস্তৃতির কথা বলা হয়। ৭ম শতকে হিউয়েন সাঙ, ষোড়শ শতাব্দীতে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে, বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হয়। উজাড় হওয়া থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও রক্ষা পাচ্ছে না।
(অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমিরের প্রবন্ধ, ২১ মার্চ ২০২১ প্রথম আলোতে প্রকাশিত)
পার্বত্য ৩ জেলা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকায় রয়েছে বিস্তৃত বনভূমি, এটি মীরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশই পাহাড় ও বনভূমিতে আচ্ছাদিত ছিল, চট্টগ্রামকে বলা হতো ‘প্রাচ্যের রাণী’। এখন সেই চট্টগ্রাম মহানগরীকে চেনা যাবে না। মহানগরীর শত শত পাহাড় টিলা সাবাড় করে দেওয়া হয়েছে। এখনো পাহাড় কাটার বিরাম নেই। সরকারি সংস্থাগুলির চোখের সামনেই চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক আভরণ ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে, যে যেভাবে পারে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সজ্জা খাবলে খুবলে নিচ্ছে। পাহাড় ধসে মৃত্যু প্রতি বছরই ঘটছে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এলাকায়।
পরিবেশ বিষয়ক নানা আইন আছে দেশে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই, চিঠি চালাচালি, শোকজ, আইনি নোটিশ আর কোন কোন ক্ষেত্রে মামলা করে পরিবেশ দফতর। এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। এদিকে পাহাড়, বনাঞ্চল সাবাড়ও চলে নীরবে নিভৃতে। রাজনৈতিকÑসামাজিক সংগঠনগুলিও তেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারে না প্রশাসনের ওপর। অথচ এর ক্ষতি, অশুভ পরিণতি বহন করতে হচ্ছে নাগরিকদের।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বনভূমি দখলদারীদের নাম প্রকাশ করতে বলেছে যাতে জনগণ তাদের শনাক্ত করতে পারে। এবারই বনভূমি দখলদারদের একটি তালিকা পাওয়া গেল, বনভূমি দখল যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বনভূমি উদ্ধার করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি। জেলা প্রশাসকদেরও চিঠি দেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা নিতে। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, এর প্রাণিবৈচিত্র্যও সমৃদ্ধ, বিশ্বের ঐতিহ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিংবা মায়াবী চিত্রল হরিণ, আরও নানা প্রাণি, বৃক্ষরাজি, নদী, ¯্রােতস্বিনী, বৃক্ষরাজি, নিবিড় অরণ্যানী নিয়ে সুন্দরবন আমাদের জাতীয় অহংকার। এটি জাতীয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি বৈচিত্র্যের অনুপম আধার। অথচ এখানে বনখেকো, বনদানবদের নিয়মিত উৎপাত, মধুশিকারিদের সারা বছরই তৎপরতা, পর্যটকদের খামখেয়ালি আচরণ যা পরিবেশ দূষণের সুযোগ করে দেয়। এসব থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন সন্নিহিত অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে আয়োজন চলছেÑআমরা ভুলে যাই যে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বর্ম্য আমাদের অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে আসছে। প্রতিনিয়তই আমাদের সে নানাবিধ দানে ঐশ্বর্যশালী করছে। তাই একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
বনভূমি বনাঞ্চল দখল করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে স্থায়ী অস্থায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, হাটহাজার, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কটেজ, ফার্ম, রিসোর্ট ইত্যাদি; কৃষিকাজ, বাগানও করা হয়েছে। পাহাড় টিলা দেদারসে কাটা হচ্ছে। আইনে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না এমন বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও তা মানছে না দখলকারীরা। তাদের আইন মানতে বাধ্যও করা যাচ্ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে যারা বন, বনাঞ্চলের আদি রক্ষক, ঐতিহ্য ও জীবনের দাবিতে যারা বনকে, প্রকৃতিকে মায়ের মতো রক্ষা করে চলেছে সে সব নৃ- গোষ্ঠীর মানুষের বনবসতি দখল করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কেবল পাহাড়ে নয়, সমতল অঞ্চলেও এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এর ফলে পাহাড় কিংবা বনাঞ্চলের বসবাসকারীরা তাদের শতশত বছরের বাস্তু থেকে উৎখাত হচ্ছে, তাদের স্থানান্তর ঘটছে অথবা নিরূপায় হয়ে তারা দেশান্তরী হচ্ছে। স্থানান্তর অথবা দেশান্তরের কারণে একটি জনপদের ইতিহাস ঐতিহ্য ভাষা সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটে যা আমাদের জাতীয় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সত্তাকে মলিন করে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস, আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিরূপ রূপান্তর প্রতিরোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণির আবাসস্থল নিরাপদ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা, মৃত্তিকা ও বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখতে বনভূমি সংরক্ষণ, বনভূমি পুনরুদ্ধার, বনভূমি বাড়াতে জাতীয় প্রচেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন। একটি ইতিবাচক দিক হলো প্রাকৃতিক বনের বাইরে গাছপালাশোভিত এলাকা বাড়ছে সামাজিক বনায়ন, উপকূলীয় বনাঞ্চল সৃজনের মাধ্যমে, শহরের ছাদবাগান এখন জনপ্রিয় হচ্ছে, ব্যক্তিগত বাগান, বাণিজ্যিক ফলবাগান বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো বৃক্ষরোপণে সচেতনতা বেড়েছে জনগণের। মুজিববর্ষে দেশব্যাপী বিনামূল্যে ১ কোটি চারা বিতরণ করা হচ্ছে। মাসব্যাপী বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ মেলা হচ্ছে। ওষুধের কাঁচামালের উৎস বৃক্ষ, নানা লতাগুল্ম। এজন্য ওষধি বৃক্ষ রোপণকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফুল ও ফল-সবজি চাষে দেশ অনেক এগিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কাজ হবে আমাদের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা ও একে উজাড়, দখল হওয়া থেকে রক্ষা করা। এ জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের অশুভ থাবা থেকে বনকে রক্ষা করার জাতীয় অঙ্গীকার হোক। সেই সাথে বন লালনে বনবাসী ও বনজীবীদের তাদের ঐতিহ্যিক জ্ঞান ও প্রথার সাহায্যে বন ও বৃক্ষকে রক্ষা করার প্রয়াসে সহযোগিতা করাও জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক