সুপ্রভাত ডেস্ক »
বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে মিথেন গ্যাসের (গ্যাস হাইড্রেটস) সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইজেড) ২২০ প্রজাতির শৈবাল (সি-উইড), ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ‘গ্যাস হাইড্রেন্ট ও সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদের ওপর গবেষণার ফলাফল’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স) রিয়াল এডমিরাল (অবঃ) মো. খুরশেদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় গত দুই বছরে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট (মিথেন গ্যাস) ও শৈবালের সম্ভাবনা, উপস্থিতি, প্রকৃতি ও মজুত নির্ণয়ের জন্য দুটি গবেষণা পরিচালিত হয়। ওই গবেষণা দুটি থেকে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি এবং বিভিন্ন প্রজাতির শৈবাল ও মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে যতটুকু এলাকা জরিপ করেছি, তাতে ধারণা করছি, ন্যূনতম ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) গ্যাস হাইড্রেটস মজুত রয়েছে সেখানে।’
খুরশেদ আলম বলেন, ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণবিষয়ক কমিশনে বাংলাদেশের পেশ করা মহীসোপানের দাবিসংবলিত প্রস্তাব তৈরি হয়। এর আগে বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮ সালে বঙ্গোপসাগরে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার এবং ২০১০ সালে একটি ডাচ প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রায় ৩ হাজার লাইন কিলোমিটার সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপ সম্পন্ন করে। এসব জরিপে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে মহীসোপানে ৬ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলে থাকা সম্পদের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটে সংরক্ষিত রয়েছে। জরিপের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই ডেস্কটপ সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সমীক্ষায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস হাইড্রেটসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পাশাপাশি গ্যাসের অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুতের ব্যাপারেও প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।
গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান কাজ চালানোর জন্য একমাত্র ডেডিকেটেড মার্কিন ফেডারেল সংস্থা এনওএএ ওশেন এক্সপ্লোরেশন-এর তথ্যানুসারে, গ্যাস হাইড্রেট তথা মিথেন গ্যাস মূলত উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফ আকৃতির এক ধরনের কঠিন পদার্থ। এটি স্তূপীকৃত বালির ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো স্ফটিক আকারে অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিণ্ড, শিট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে।
মহীসোপানের প্রান্তসীমায় ৩০০ মিটারের বেশি গভীরতায় সমুদ্রের তলদেশের নিচে গ্যাস হাইড্রেট পানি ও মাটির চাপে মিথেন বা স্ফটিক রূপে বিরাজ করে, যা সাধারণত ৫০০ মিটার গভীরতায় স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। স্থিতিশীল গ্যাস হাইড্রেটসমৃদ্ধ এ অঞ্চল সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
প্রাকৃতিকভাবে কিছু সামুদ্রিক পলিতে এবং ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট গঠিত হয়।
হাইড্রেটের মজুদ বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কয়লা, তেল ও প্রচলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্মিলিত মজুদে যে পরিমাণ কয়লা থাকে, গ্যাস হাইড্রেট মজুদে তার প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন থাকতে পারে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশে সামুদ্রিক সিওয়েড’ থেকে বিশেষ ধরণের গবেষণালব্ধ প্রাপ্তির তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা”-এর আলোকে ‘সুনীল জৈবপ্রযুক্তি’ খাত উন্নয়নের জন্য রিয়াল এডমিরাল (অবঃ) মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট, নেদারল্যান্ডস্ সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ অর্থাৎ এমজেআর বলে পরিচিত সমুদ্রের প্রাণিজ ও উদ্ভিদ সংক্রান্ত সকল সম্পদের উপস্থিতি, সার্বিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তথা বাণিজ্যিকীকরণ যাচাইয়ের লক্ষ্যে বিগত ২ বছর যাবৎ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রতিনিধিসহ নেদারল্যান্ডস্ ভিত্তিক গবেষক ২০২০ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উক্ত গবেষণা হতে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় (ইইজেড) এমজেআর-এর সার্বিক অবস্থান চিহ্নিত করা (ম্যাপিং), বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করাসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেন। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ২২০ প্রজাতির সিওয়েড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়।
তিনি জানান, পরবর্তীতে এ সকল প্রজাতির উপর প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট নেদারল্যান্ডসে সম্পন্ন করা হয়। কোভিড-১৯ জনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গবেষণা কার্যক্রমে সাময়িক বিরতির পর ২০২১ সালে তা পুনরায় শুরু হয়। উক্ত কার্যক্রমে বিশেষ করে বাংলাদেশে সিওয়েড এর সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
শাহরিয়ার আলম বলেন, গবেষণালব্ধ ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বহু সংখ্যক প্রজাতির সিওয়েড এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশে প্রাপ্ত নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু সিওয়েড-এর ৫টি শিল্পভিত্তিক প্রয়োগ চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েড এ প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে যা ফিস ফিড এর প্রোটিনের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং ফিস ফিডের জন্য আমদানিকৃত ফিস ওয়েলের বিকল্প হতে পারে, যার বাজার অত্যন্ত ব্যাপক।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাটি এসিড রয়েছে যা এ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ও প্রাণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এ্যানিমেল ফিডের বিশাল বাজার রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত কিছু প্রজাতির সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণ অ্যাগার-অ্যাগার রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পে বর্তমানে অ্যাগার- অ্যাগার আমদানি করে তা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া, সিওয়েড সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ খাবারের সাথে গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পসমূহে প্রক্রিয়াজাত সিওয়েড এবং অ্যাগার-অ্যাগার এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশের সিওয়েডে প্রচুর ‘জেলিং এজেন্ট’ রয়েছে যা বাল্ক কসমেটিকস ইনগ্রিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের প্রসাধনি শিল্পে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে আমদানি করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সিওয়েডে প্রচুর পরিমাণে হাই ভ্যালু কসমেটিকস ইনগ্রিডেন্ট রয়েছে যা স্সিন কেয়ার সামগ্রি সহ বহুবিধ প্রসাধনি সামগ্রি তৈরিতে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামুদ্রিক সিওয়েড থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও পরিচালনার জন্য হ্যাচারি, ফার্মিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট এবং শিল্পভিত্তিক প্রয়োগ প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সিওয়েডের উৎপাদন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে অতি সহজেই করা সম্ভব। সিওয়েডের চাষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সিওয়েডের চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের জন্য সহজ ও নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মীর সহজ কর্মসংস্থান হতে পারে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনীল অর্থনীতি কার্যক্রম গ্রহণের পর দেশ সরাসরি সমুদ্র সম্পদ থেকে নতুন বাণিজ্যিক সম্পদ আহরণের একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে, আগ্রহী ও যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সিওয়েডের সম্ভাবনাময় বিবিধ খাতে কার্যকরী বিনিয়োগ বা অংশগ্রহণ করানো। উল্লেখ্য, উক্ত কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে যোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট থেকে প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, সরকার প্রত্যাশা করছে, যে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সিওয়েডকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন তারা তাদের লাভের একটি অংশ বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যবহার করবেন।