রাজিব শর্মা »
কোনো ধরনের আমদানি সংকট বা সরবরাহ ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে বাজারে আবারও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে আমদানি করা পেঁয়াজ। পাকিস্তনি যে-মানের পেঁয়াজ গত তিনদিন আগেও কেজি প্রতি বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়, গতকাল তা পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
গতকাল শনিবার নগরীর খাতুনগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে সরেজমিনে এ চিত্র দেখা যায়। এছাড়া বাজারে পাইকারি ও আড়তে ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক অঞ্চলের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা। অন্যদিকে পাইকারি বাজারের আড়ত ছিল দেশীয় পেঁয়াজশূন্য। খুচরা বাজারে নাসিক পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা আর পাকিস্তানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। বাজারে দেশি ছোট পেঁয়াজের চাহিদা কম থাকায় ব্যবসায়ীরা এ পেঁয়াজ বিক্রি করছে না বলেও জানা গেছে।
গরমিল টিসিবিতেও
এদিকে সরকার দেশীয় পেঁয়াজের দর খুচরা পর্যায়ে কেজি প্রতি ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ওই দামে মিলছে না দেশি পেঁয়াজ। এমনকি মিলছে না আমদানির পেঁয়াজও। সংস্থাটির মতে, গতকাল খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। যা গত বছর এদিনে বিক্রি হয়েছিল কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে শতভাগ। আর আমদানির পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা। যা গতবছর এদিনে বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে এ পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০৭ শতাংশের বেশি।
এদিকে পাইকারি আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমদানিতে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। আবার ভোমরা ও সোনা মসজিদ স্থলপথ দিয়ে যেসব পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে তার আমদানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারে করা।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. ইরফানুল হক বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজের তেমন চাহিদা নেই। ফলে ভারতের পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। তাছাড়া ভোমরাবন্দর থেকে ১৪ টনের একটি ট্রাকে করে পেঁয়াজ আনতে হলে খরচ পড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। যা কেজি প্রতি হিসেব করলে পরিবহন খরচসহ ৬৪ টাকার বেশি দর নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু আমরা পচনশীল পণ্য হিসেবে আমদানির পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৪ টাকা লোকসানে বিক্রি করছি।
সরকারের নির্ধারিত দেশি পেঁয়াজের দামের বিষয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, সরকার নির্ধারণ করে দিলেও দেশি পেঁয়াজ বাজারে না থাকায় তার প্রভাব পড়েনি। তাছাড়া আড়তদারদের পক্ষ থেকে ওই দরে বিক্রির কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় জানা যায়নি। আমরা যেদিন যত কেনা পড়ে তার হিসেব করে বিক্রি করছি। সরকারি নির্দেশনা বাজারে আসেনি।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিছ বলেন, সরকার দেশি পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করে দিলেও আমদানিকৃত পেঁয়াজের বিষয়টি জানায়নি। তাছাড়া খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের তেমন চাহিদা নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এক কথায় বলা যায়, খাতুনগঞ্জের বর্তমান পেঁয়াজের বাজার আমদানিরনির্ভর। সুতরাং বর্তমান আমদানি খরচের সাথে সমন্বয় করে কযেক টাকা লাভে আড়তদারেরা বিক্রি করছে।
আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে মে মাসে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। এক পর্যায়ে দাম গিয়ে ঠেকে শতকে। এরপর কৃষি মন্ত্রণালয় গত ৫ জুন থেকে আমদানির অনুমতি দিলে দাম কিছুটা কমে আসে। ধাপে ধাপে কমে তখন ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় নেমে আসে। এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। যদিও দেশে গত অর্থবছরে ভালো ফলন হয়েছে পেঁয়াজের। পাশাপাশি আমদানি ও সরবরাহও ভালো রয়েছে বলে জানা যায়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার টন। তবে উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। গড়ে ৩০ শতাংশ নষ্ট হলেও মোট উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৪ লাখ টন।
অন্যদিকে দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। সেই হিসাবে ২ থেকে ৪ লাখ টনের ঘাটতি থাকে। অথচ এর চেয়ে বেশি পরিমাণে আমদানি হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ওইসব আমদানিকৃত পেয়াঁজ ভোমরা ও সোনা মসসিদ স্থলবন্দর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ করেছে।
বাজারে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে কিনা, জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বরাবর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি ।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর সহকারী পরিচালক রানা দেবনাথ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বাজার তদারকি করছি। আজকে দেখলাম পাইকারি পর্যায়ে কেজি প্রতি আমদানি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা বিক্রি করা হলেও অতি মুনাফার লোভে চড়া দরে পেঁয়াজ বিক্রি করে খুচরা ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজের বিষয়ে আলোচনা করে শ্রীঘ্রই অভিযান জোরদার করা হবে।’