সুপ্রভাত ডেস্ক :
বাংলাদেশের বন বিভাগ বলছে যে দেশটির পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জঙ্গলে নতুন করে বাঘ ছাড়া যায় কি-না এবং সেখানে বাঘের পুনঃপ্রবর্তন করা হলে এগুলো টিকে থাকতে পারবে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে একটি সমীক্ষার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলছেন, সমীক্ষা করে দেখা হবে যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ওই বনে বাঘের থাকার উপযোগী পরিবেশ ও খাদ্য আছে কি-না এবং একই সঙ্গে সেখানে বাঘের জন্য কোনো হুমকি সেখানে আছে কি-না। খবর বিবিসি বাংলার।
তিনি বলেন, “এই সমীক্ষা চালানো হবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে। তারা ট্র্যাকিং করে দেখবেন পার্বত্য অঞ্চলে ইতোমধ্যেই বাঘের উপস্থিতি আছে কি-না। না থাকলেও তাদের আবাসস্থল ও খাদ্যের পরিবেশ আছে কি-না। একই সাথে দেখা হবে যে বাঘ সেখানে ছাড়লে তারা টিকবে কি-না, সারভাইভ করবে কি-না”।
বাংলাদেশে এখন কেবলমাত্র ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সুন্দরবনে বাঘের আবাসস্থল রয়েছে, যদিও এক সময় দেশটির বেশিরভাগ অঞ্চলে বাঘের পদচারণা ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শিকারীদের হাতে ব্যাপক সংখ্যায় বাঘ মারা পড়ার পর সুন্দরবনে মাত্র শ’খানেক বাঘ টিকে আছে বলে সর্বশেষ বাঘ শুমারীতে দেখা গেছে।
আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঘ নিয়ে যে ফিজিবিলিটি স্টাডিজ চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় মাত্রই অনুমোদন করেছে এবং খুব শিগগিরই বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেয়া হবে যাতে করে আগামী জুনের মধ্যে সমীক্ষাটি শেষ করা যায়।
তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই বাঘ ছিলো কিন্তু এখন খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা – এই তিন জেলায় বাঘ টিকে রয়েছে।
“এর বাইরে গবেষকরা পার্বত্য অঞ্চলের কথাও বলছেন। কেউ কেউ ওই অঞ্চলে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়ার কথা বলেছেন। তাতে মনে হয়েছে যে সেখানে বাঘ ঘোরাফেরা করতে পারে।”
ওই অঞ্চলে বাঘের সম্ভাব্য যে উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ভারত বা মিয়ানমার থেকেও আসতে পারে বলে মনে করেন প্রধান বন সংরক্ষক। “সে কারণেই ওখানে বাঘের রিইনট্রোডাকশন করা যায় কি-না, এ চিন্তা থেকেই সমীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা”।
আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঘ ছাড়ার আগে দেখতে হবে ওই এলাকায় বাঘের প্রয়োজনীয় আবাসস্থল ও পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কি-না, কিংবা কোন ধরণের নিরাপত্তা হুমকি আছে কি-না।
“পাশাপাশি দেখতে হবে বাঘ সুরক্ষার সক্ষমতা সেখানে আমাদের আছে কি-না। কারণ বাঘ ছাড়া হলো আর কয়েক মাস পর সেগুলো মারা গেলো বা কেউ মেরে ফেললো – এটি তো হতে দেয়া যাবে না”।
এসব প্রশ্নের উত্তর মিললে এ সম্পর্কিত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে আশা করছেন প্রধান বন সংরক্ষক।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন ওয়াইল্ডটীমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে বাঘ নিয়ে সমীক্ষায় কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব পেতে হবে।
তিনি বলেন, “প্রথমত বাঘের জন্য যথার্থ আবাসস্থল ও খাদ্য আছে কি-না। এরপর দেখতে হবে সেখানে বাঘের নিরাপত্তা ও বাঘকে সুরক্ষা দেয়ার সক্ষমতা বন বিভাগের আছে কি-না।”
তিনি আরও বলেন, দেখতে হবে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না। কারণ এটা না করে বাঘ ছাড়া হলেও সেগুলো চলে যেতে পারে।
এছাড়া, যেখান থেকে বাঘ নেয়া হবে সেখানকার ইকো-সিস্টেমের সাথে পার্বত্য অঞ্চলের ইকো-সিস্টেমের সাদৃশ্য আছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশে আগেও এক জায়গার প্রাণী আরেক জায়গায় ছেড়ে দিয়ে সুফল আসেনি। বাঘের ক্ষেত্রে এটি আরও স্পর্শকাতর বিষয় – জানান আনোয়ারুল ইসলাম।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলছেন যে পুরো সিদ্ধান্তটিই নির্ভর করবে সমীক্ষা রিপোর্টের ওপর।
“বাংলাদেশে এ ধরণের কাজ আগে না হলেও ভারতে হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাও দরকার হলে আমরা নেব। ইতিবাচক রিপোর্ট আসলে তখনই বোঝা যাবে কোন জায়গা থেকে বাঘ আনা যাবে। আর রিপোর্ট যদি বাঘের যথাযথ পরিবেশ থাকার নিশ্চয়তা না দেয়, তাহলে এটি আমরা করবো না,” বলেন তিনি।
প্রায় এক দশক আগে রাশিয়ায় যে ‘টাইগার সামিট’ হয়েছিলো, সেখানে বাঘ আছে বাংলাদেশসহ এমন ১৩টি দেশ ২০২২ সালের মধ্যেই বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার করেছিলো।
মূলত এর পর থেকেই বাঘ নিয়ে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ এবং নেয়া হয় নানা ধরণের উদ্যোগ।
এর মধ্যে গত বছর বন ও পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে বন বিভাগের তরফ থেকে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়, যেখানে উঠে আসে পার্বত্য অঞ্চলে বাঘের সম্ভাব্য বাসস্থান করার বিষয়টিও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাঘ গবেষক মনিরুল এইচ খান মনে করেন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনই বাঘের চলাচল রয়েছে।
“পার্বত্য অঞ্চলে বাঘের উপস্থিতি সেখানে আছে এমন প্রমাণ আছে”।
তিনি বলেন, জরিপে বাঘের উপস্থিতি নিশ্চিত হতে পারলে পার্বত্য অঞ্চলেও তাদের প্রটেকশনের জন্য করণীয় পদক্ষেপ নেয়াটা সহজ হবে।
কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে কাসালংয়ে এবং এর তিন বছর পর রেমাক্রিতে বাঘ হত্যার রেকর্ড পাওয়া যায়। আবার স্থানীয়দের দেয়া তথ্যকে উদ্ধৃত করে তারা বলছেন যে ২০০৯ সালে রাইক্ষংয়ে জীবন্ত বাঘের দেখা পেয়েছিলের সেখানকার বাসিন্দারা।
২০১৬ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো যে প্রকৃতি সংরক্ষণবিদদের একটি দল পার্বত্য অঞ্চলের জঙ্গলে অনেক বন্য প্রাণীর ছবি তুলেছেন এবং তারা ১৩ সেন্টিমিটারের একটি থাবার চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন, যেটিকে বাঘের থাবা বলেই মনে করেছেন তারা।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পুরনো রেকর্ডপত্র এই নিশ্চিত করছে যে ওই অঞ্চলে বাঘ ছিলো এবং এখনও সাঙ্গু অভয়ারণ্য কিংবা কাসালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বাঘ থাকতে পারে।
সরকারের উপপ্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই অঞ্চলটিতে অনেকে বাঘ দেখেছেন কিংবা সেখানে বাঘের উপস্থিতির কথা অনেকবার শোনা গেছে।
“কিন্তু বাঘ কি এখানকারই না-কি মিয়ানমার বা ভারত থেকে আসা যাওয়া করে, তার কোনো প্রমাণ নেই। সে কারণেই আমরা সামনে সুন্দরবনের সাথে পার্বত্য অঞ্চলেও ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে জরিপের সিদ্ধান্ত নিয়েছি”।
এছাড়া, পার্বত্য এলাকায় একটি ফরেস্ট করিডোর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ যাতে করে বাঘ কিংবা হাতির মতো প্রাণীর জন্য অবাধে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হয়।
কত বাঘ আছে বাংলাদেশে
২০১৯ সালের মে মাসে বন বিভাগ ও বাঘ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে করা জরিপের ফল অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিলো ১১৪টি।
ওই জরিপের জটিল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঘ গবেষক অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজ। তিনি তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন যে ২০১৫ সালের বন বিভাগের জরিপে ১০৬টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া গেলেও ২০১৯-এ এসে তারা ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব পেয়েছেন।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে সুন্দরবনকে খুলনা,বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অংশে ভাগ করে প্রায় দু’বছর ধরে জরিপটি চালানো হয়। প্রায় ৫০০ ক্যামেরা ২৪৯ দিন চালু রেখে প্রায় আড়াই হাজার ছবি তুলে সেগুলো পরে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা পর্যালোচনা করেন।
বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হলে এবার পার্বত্য অঞ্চলেও একই কায়দায় জরিপ চালানো হবে।