দীপক বড়ুয়া »
পাহাড়ের কোলে বৃষ্টি পড়ছিল তখন। পদ্ম বৃষ্টি পড়া দেখে। এই বৃষ্টি মায়া মেশানো, আছে মৃদু হাওয়া। শান্ত সাবলীল। পাহাড়ের চরিত্রটা অদ্ভুত। সমতলের কত পার্থক্য, কত অমিল। পাহাড়ের কোলে বৃষ্টির ছন্দ-সুর মন ছুঁয়ে যায়। এখানে বৃষ্টির জল সহজে নেমে যায়। জমে থাকে না। সমতলে বৃষ্টির জল জমে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। চলতি পথে কষ্টের সীমা থাকে না। মা-বাবার দুই সন্তানের পদ্ম একজন। দ্বিতীয়জন হৃদ্ধ, ছোটোভাই। মধ্যবিত্ত পরিবার ওদের। বাবা একটি অফিসে চাকরি করেন। রাঙামাটি তাদের বাড়ি। অতো চাওয়া-পাওয়া নেই। অভিলাষের স্বপ্ন শুধু দুই সন্তানকে মানুষ করা। মা হিমাদ্রি সরকারি প্রাইমারি ইশকুলের শিক্ষক। একটি সুখী-সচ্ছল পরিবার। বৃষ্টির ফাঁকে মায়ের ডাক,
পদ্ম কোথায় গেলি? এদিকে আয়। কলেজ বন্ধ, মাকে একটু সাহায্য করবি। পদ্ম বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টির শব্দে মায়ের ডাক শোনেনি। মায়ের গলার আওয়াজ এবার বড় হয়। পদ্ম তাড়াহুড়ো করে চলে আসে।
মা, ডাকছো?
-কি করছিলি, ডেকেছি আমাকে সাহায্য করতে।
-বলো কি করবো?
-রান্নার চুলোটা পরিষ্কার কর। ময়লা জমে আছে। সবজি কুটে চুলোয় দেবো।
-ঠিক আছে, মা।
পদ্মের তুলনা নেই, কি লেখাপড়া, কি কাজে সমান পারদর্শী। ছেলেবেলা থেকে পড়ায় ভালো পদ্ম। মা নাম রেখেছে পদ্মকলি। ছেঁটে সবাই
ডাকে পদ্ম। বাবা বলে, ভারি মিষ্টি নাম পদ্মকলি। পদ্ম নামে আদর ঝরে যেন। তখন থেকে ওই নামে সবাই জানে। কলেজে ও এ-নামেই
পরিচিত। শুভাশিস, রক্তিম, বাবুল, হাসান, দিদার, বাবু, দীপা, শুভশ্রী পদ্মের সাথে পড়ে।
পদ্ম আর শুভাশিসের বাড়ি কাছাকাছি। প্রাইমারি, হাই ইশকুলে এক সাথে পড়ত। এখন কলেজে। দুজনের দেখা হয়, কথা হয়।কলেজ ছুটির পর
বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। কলেজের পরে উঁচু পাহাড়। ছোটোবড় নানা সবুজ গাছের কোলে পাহাড় শুয়ে আছে যেন। পদ্ম-শুভাশিস বাসায় ফিরছিল।
দুজনই কাকভেজা, জবুথবু। কারো ছাতা নেই। আজকাল বৃষ্টি সময় বুঝে না। ইচ্ছে হল তো পড়ছে, থামছে। শুভাশিস অনেকদিন ধরে পদ্মকে
একটি কথা বলতে চায়। সে ভীতু, লাজুক, কম কথা বলে। পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। মুখে কারো কথা নেই। হঠাৎ শুভাশিস বলে, পদ্ম একটি
কথা বলার ছিল। পদ্মের লাজুকতা ঝরে পড়ে তখন। লাজুক ঠোঁটে কথা বেরোয়,
-ওই দেখছ, পথটা পিচ্ছিল। আনমনে হাঁটলে রক্ষা নেই। পড়বই।
শুভাশিস আবারও বলে, একটি কথা ছিল পদ্ম।
তখনই মেঘ ডাকে, বিদ্যুৎ চমকায়। ভয়ে পদ্ম শুভাশিসের হাত ধরে বলে, হাত ধরলাম, রাগ করেছ? শুভাশিসের কেমন মনে হয়। এই প্রথম
কোনো মেয়ের স্পর্শ। ছ্যাঁৎ করে ওঠে সারা শরীর। ভীষণ ভালো লাগল শুভাশিসের। তৃতীয়বারও বলার চেষ্টা করে সে। বলে ও,
একটি কথা বলব পদ্ম?
বৃষ্টির চাপটা বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ চমকানো প্রচণ্ডভাবে বাড়ে। পদ্ম শুভাশিসকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
কি শুরু হল বলো তো! বিদ্যুৎ চমকানো ভয় পাই। আমাকে ছেড়ো না শুভাশিস।
শুভাশিস পদ্মের মাথায় হাত রাখে অবলীলায়। ভেজা চুলে সুগন্ধ বেরোয়। নিশ্চয়ই শ্যাম্পু করেছে। মনে-মনে বলে, যা চাইছি, তার চেয়ে বেশি
পেয়েছি। পদ্ম নিজেকে ছেড়ে নেয় শুভাশিসের বুক থেকে। লজ্জায় বলে,
ছি, কিছু মনে করো না।
-তুমি সহজ-সরল শিশুর মতো। খুব ভালো লাগে। এমনটি থেকো চিরদিন। শুভাশিস বলে।
-জানো শুভাশিস, পৃথিবী-প্রকৃতি ভারি অদ্ভুত। সময়-অসময় বুঝে না। যখন-তখন যা ইচ্ছে করে বসে। এখানে মানুষের হাত নেই।
-তুমি আমার বন্ধু, সাথি। শুভাশিস বলে।
-কোন্ সাথির কথা বলছ? পদ্মের ফিরতি প্রশ্ন।
শুভাশিস ভয়ে চুপ। প্রায় বাসার কাছাকাছি ওরা। আর কথা হয় না।
হিমাদ্রি তাড়াতাড়ি ফিরেছে ইশকুল থেকে। অভিলাষও বাসায়। পদ্মকে ভেজা দেখে হিমাদ্রি বলে,
ভিজছিস তো! বারবার বলি সঙ্গে ছাতা রাখবি। ঠান্ডায় জ্বর আসতে পারে, তখন কলেজ যেতে পারবি না, হবে তো! যা তাড়াতাড়ি কাপড়
পাল্টে নে। পদ্ম নিজের ঘরে ঢুকে কাপড় ছাড়ে। মন প্রশ্ন করে,
একি করলি তুই? শুভাশিসকে জড়িয়ে ধরলি, ছিঃ ছিঃ, বড্ডো অন্যায় এটা।
-ও তাই তো। কিছু ভেবে জড়িয়ে ধরিনি, ভয়ে ধরেছি। তাতে ক্ষতিটা কি?
-কিছু মনে হয়নি তোর? উপলব্ধি হয়নি পুরুষস্পর্শ অন্যরকম।
-কি মনে হবে!
-জানিস, ছেলের স্পর্শে ভালোবাসা হয়! প্রেম জাগে মনে। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখায়।
পদ্ম ভালোবাসার অর্থ কি জানে না। নাটক-সিনেমায় দেখেছে নায়ক-নায়িকার প্রেম। জড়িয়ে ধরা।
শুভাশিস আমার বন্ধু, এর চেয়ে বেশি নয়। বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধোয়। ভাবে, বারবার শুভাশিস কি যেন বলতে চেয়েছিল। ভালোবাসার কথা?
ধুৎ, পিচ্ছি ছেলে শুভাশিস। সেও তো আমার মতো। প্রেমের অত সব কি বোঝে সে।
পরদিন কলেজ যাবার পথে দেখা। শুভাশিস বলে,
চলো, দেরি হয়ে যাবে। আজ অন্যরকম দেখায় শুভাশিসকে।
ঠোঁটে হাসি, প্রাণোচ্ছল। সব সময় কথা বলে না। আজ বলছে,
বৃষ্টিতে ভিজলে গতকাল। ভেবেছিলাম জ্বর-টর হলো না তো।
-আমাকে নিয়ে এত ভাবনা!
-ভেবেছি।
-কেন ভাববে?
-তোমাকে আমার ভালো লাগে। ভালোবাসি, তাই ভেবেছি।
-আর ভাববে না কোনদিন।
-ভাববো না কেন?
-আমার পছন্দ নয়।
-কাকে?
পদ্মের কথা আটকে যায়। মনে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরার কথা। শুভাশিসের স্পর্শ। তাতে কি হল। বিপদে পড়লে এরকম হতেই পারে। দুজন
পাশাপাশি হাঁটছে। কলেজে মন বসে না পদ্মের। কি হল হঠাৎ। শুভাশিস দুবছরের সিনিয়র। পদ্ম ইন্টারমেডিয়েট, শুভাশিস ডিগ্রির
ছাত্র।
শেষের ক্লাস না করে বাড়ি ফিরে পদ্ম। ভালো লাগে না কিছু। কি পড়তে, কি কাজ করতে। সেদিন বাড়িতে কেউ নেই। পাশের বাড়ির
অনুষ্ঠানে গেছে। ডোরবেল বাজে। পদ্ম দরজা খুলতেই দেখে শুভাশিস। হাতে ফুল। পদ্মের প্রশ্ন,
তুমি হঠাৎ, হাতে ফুল, ব্যাপার কি শুভাশিস।
-বাইরে দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলবে। আসতে বলবে না।
-না। মা-বাবা-ভাই কেউ নেই। তাই চলে যাও।
শুভাশিস নিম মুখে ফিরে যায়। পদ্ম দরজা বন্ধ করে নিজেকে অপরাধী ভাবে। শুভাশিস কি মনে করবে।
কিছুদিন পর। পদ্ম হৃদ্ধকে নিয়ে ফিরছিল। সন্ধ্যে ছেড়ে রাত তখন। পাহাড়ি পথ, আঁকাবাঁকা। পথ আটকায় কিছু বখাটে। ওরা পদ্মের গা ছুঁতে
চায়। লাঞ্ছিত করার জন্য উদ্যত হয়। কটূক্তি করে। ভয়ংকর চিৎকার করে পদ্ম। সাথে হৃদ্ধও। জনশূন্য পথ। তার ওপর রাত। কেউ নেই। কে
কার কথা শোনে! ঝিঁঝিঁ ডাকছে কাছে, দূরে। শেয়ালের বীভৎস চিৎকার ভেসে আসে।
শুভাশিস ফিরছিল বাজার থেকে। হাতে টর্চ। ব্যাটারি কমে যাওয়ায় ক্ষীণ আলোয় দূরের কিছু দেখা যায় না। সামনের হইচইয়ের দিকে এগিয়ে
যায়। দেখে পদ্ম, হৃদ্ধকে। কয়েকটা ছেলের ঝাপটা-ঝাপটি। শুভাশিস ক্ষেপে যায়। পাশের গাছ থেকে ডাল ভেঙে ওদের মারতে এগিয়ে যায়।
এলোপাথাড়ি মারের চোটে বখাটেরা শুভাশিসকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। টর্চের আধো আলোয় দেখে অঝোরে রক্ত ঝরছে শুভাশিসের হাত
থেকে। পদ্ম বিহ্বল। তাড়াতাড়ি ওড়না ছিঁড়ে শুভাশিসের রক্তঝরা ক্ষত বেঁধে দেয়। পদ্ম বলে,
কি দরকার ছিল বখাটেদের মারার।
-তোমাকে অপমান করছে, আমি চুপ থাকবো? সে কি হয়!
-যদি আরও মারাত্মক ঘটনা ঘটতো। ছুরির আঘাতে তোমার মারাত্মক ক্ষতি হত, তখন?
-তবু সেই ভালো হত।
-কেন? তুমি আমার কে?
-ভালেবাসা। সে তুমি বুঝবে না। বুঝতে চাইলে বুঝতে। তোমাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, পদ্ম।
-ঠিক আছে। চলো, চলো, বাড়ি চলো। শুভাশিসকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় পদ্ম, হৃদ্ধ।
অভিলাষ, হিমাদ্রি এমন ঘটনায় অবাক, স্তদ্ধ। অভিলাষ দৃঢ়স্বরে বলে, এভাবে দেশের অবক্ষয় হবে কতদিন। একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আমরা।
আমাদের ছেলেদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হবে না! নিশ্চিন্তে রাতদুপুরে চলাফেরা করতে পারবে না দেশের মানুষ! হিমাদ্রি বলে,
আগে নিজেকে বুঝতে হবে। আমি যে কাজটি করছি, ভালো না মন্দ। নিজেকে তো শুদ্ধ করা প্রয়োজন। আমি ভালো না হলে, আমার
পরিবারের সদস্যরা না পাল্টালে সমাজ তো দূরের কথা, দেশের মানুষের পরিবর্তন, সেটা দুর্লভ নয় কী? অভিলাষ প্রশ্ন করে,
সুভাশিস এখন কেমন আছে পদ্ম?
-জানি না বাবা। আজ ওর জন্য শ্লীলতাহানি হয়নি আমার। নিরাপদে বাড়ি ফিরলাম।
-রক্ত বন্ধ হয়েছে?
-ওড়না ছিঁড়ে বেঁধে দিয়েছিলাম, এই, এতটুকু।
-ঠিক আছে, ছেলেটিকে দেখে আসি। একটু কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার।
ডাক্তার এসে বেন্ডেজ, ইনজেকশন দিয়েছে। শুভাশিসের বাবা বলেন।
-এখন কেমন লাগছে, বাবা।
-ভালো।
-আপনার ছেলের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম, প্রত্যুষবাবু।
-সে কি বলছেন, এটা তো নৈতিক কর্তব্য ছিল ওর!
-ধন্যবাদ।
গভীর রাতে পদ্মের ঘুম আসে না। ছটফট করছে সারাক্ষণ। শুভাশিসকে কত অপমান না করলাম। ছি ছি! ও অনেক কথা শুনিয়েছে। আমাকে পছন্দ, ভালেবাসে। ওটা কেমন! দেখা-ছোঁয়া যায়? কি জানি! মুঠোফোন বাজে। পদ্ম ভাবে, এত রাতে কার কল! অন করতেই দেখে শুভাশিসের নাম্বার। তড়িঘড়ি বলে,
শুভাশিস এখন কেমন আছ। তোমার বড্ড ক্ষতি হল আমার জন্য। আমাকে ক্ষমা করো।
-কি বলছ। আমার দায়িত্ব ছিল। যা করার করেছি। একটি কথা বলার ছিল, যদি আপত্তি না করো। শুভাশিস ভয়ে-ভয়ে বলে।
-হ্যাঁ বলো।
-তুমি খুব মিষ্টি। নামটাও দারুণ, পদ্মকলি। বাবা-মা ডাকে পদ্ম। আমি ডাকতে চাই কলি নামে। পদ্ম ফোটার আগে কলি হয়। ওই কলি নামে
ডাকব শুধু আমি। তুমি কি চাও? পদ্মের বলার ভাষা নেই।
-ঠিক আছে, তাই হবে। অস্পষ্ট গলায় পদ্ম বলে। পরপর ভাবে, এই কি প্রেম! কাউকে ভালোবাসার ইঙ্গিত! ঠোঁট কামড়ে হাসে পদ্ম।
অপর প্রান্ত থেকে পষ্ট শোনা যায়, শুভরাত্রি কলি।
পদ্মও ছাড়ে না। নিঃসংকোচে বলে, শুভরাত্রি, শুভাশিস।