হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
সমস্ত প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীন’র জন্য, যিনি প্রত্যেক বস্তুর নিজ নিজ ভাষায় অবিরত প্রশংসিত হয়ে আছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি পবিত্রতা ভালবাসেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের ওপর আহলে বাইতের মুহাব্বত আবশ্যকীয় করেছেন।
আল্লাহ্র একত্বের সাক্ষ্য দেই, যিনি একমাত্র মা’বুদ। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নাই। তাঁর রাসূলের রিসালতেরও সাক্ষ্য প্রদান করি, যিনি শেষ নবী ও রাসূল, আল্লাহ্র বন্দেগীর এক মূর্তরূপ। পবিত্র কুরআন তাঁর ওপর অবতীর্ণ, সে কিতাবের ব্যবহারিক রূপ তিনিই।
আল্লাহ্ তাআলা পৃথিবীতে তাঁর খেলাফতে রাব্বানী প্রতিষ্ঠার জন্য ইনসানকেই মনোনীত করেছেন। শুধু তাঁর ইবাদত করা, সিজদা করার মধ্যে তাঁর প্রভুত্বের মহিমা যথার্থ প্রতিষ্ঠা হয় না। সিজদা করার জন্য অগণিত, অসংখ্য ফেরেশতা তখনও ছিলেন, এখনও আছেন। কিন্তু যে সিজদার সাথে সাথে সমূহ বাধাÑবিপত্তি ও বিরুদ্ধ সকল অপশক্তির মোকাবেলা করে তাঁরই রাজ মানবসমাজে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নেই, তাতে বন্দেগীর শ্রেষ্ঠত্ব, মহিমা যথার্থরূপে ফুটে ওঠে না। এজন্যই আপাদমস্তক মূর্ত করুণা হয়েও খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে প্রচ- রুদ্ররূপ হয়ে প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছেন আমাদের নবীজি রহমতুল্লিল আলামীন, হাবীবে রাব্বুল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁরই দৌহিত্র, শান্তির অবতার, হিংসামুক্ত প্রাণ, ফাতেমার জান ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.)ও প্রচ- রাজদ্রোহের সামনে আল্লাহ্র আধিপত্য, তাঁর সার্বভৌম ও শর্তহীন খোদায়ীর সামনে বন্দেগীর মহিমা তুলে ধরতেই কারবালার ময়দানে এমন অসমযুদ্ধে বিক্রম প্রদর্শন করেন।
ঈমান’র পরে সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফরয ইবাদত হল নামায। কুরআনÑহাদীসে নামায’র মত এত গুরুত্ব আর কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে আরোপিত হয়নি। দৈহিক ইবাদত নামায, আর্থিক ইবাদত যাকাত। এ দু’টির এতই পুনরুল্লেখ পবিত্র কুরআনে রয়েছে যে, সেরূপ আর কোন ইবাদতের প্রসঙ্গে হয়নি। যে মুমিন জেনে বুঝে, স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে নামায পরিহার করে, সে মহাপাপী। আর এ অবজ্ঞা যদি বৈধ জ্ঞান করে, তা স্পষ্ট কুফরী। এজন্যই আল্লাহ্র রাসুল ইরশাদ করেন, ‘মান তারাকাস সালাÑতা মুতাআম্মিদান ফাক্বাদ কাফারা’। হালাল ভেবে নামায বর্জন নিঃসন্দেহে কুফরী। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ইয়াযীদের মধ্যে এ স্বভাব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। তাই তাকে খলীফা মেনে নেয়া ইমাম হুসাইনের মত সমকালীন সর্বজনমান্য ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয়নি। অসহায় অবস্থায় এনে ঘিরে ফেলা সশস্ত্র বাহিনীর সামনে তাঁকে সত্যের মহিমা তুলে ধরতে যুদ্ধের বিকল্প ছিল না। অন্তত ইমাম হুসাইনের পক্ষে তো কোনভাবেই নিরাপদে প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা বৈধ নয়। ইসলামের বিজ্ঞ মহল এ অবস্থাকে ‘আযীমত’ বলেছেন। তারপরও এটা ছিল তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ। সমস্ত কিছুর যবনিকায় শহীদÑকুলÑস¤্রাট, সাধক রাজন হুসাইন (রাদ্বি.) আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সিজদাবনত অবস্থায় শাহাদত বরণ করেন।
নামাযের মধ্যে বান্দা আল্লাহ্র সর্বাধিক নৈকট্যে থাকে সিজদারত অবস্থায়। নামাযের যত রুকন রয়েছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিজদা। সিজদার হালতে বান্দার সবচেয়ে দীনহীন অবস্থার প্রকাশ ঘটে। এখানে তার বিনয় ও দীনতা প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। আমাদের প্রিয় নবী শুভ আবির্ভাবের মুহূর্তে সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। তাঁর ‘আবদিয়্যত’ (বন্দেগীর পরিচয়) প্রকাশ করার জন্য তিনি ভূমিষ্ট হয়ে প্রথমে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়েন। পরম আরাধ্য প্রভু আল্লাহ্র আনুগত্য প্রকাশ করেই তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। মর্ত্যরে মাটিতে আভূমিলুণ্ঠিত হয়ে তাঁর প্রভুত্বের জয়গান ঘোষণা করেন। তাই আল্লাহ্ও তাঁকে বান্দার পরিচয়ে লাÑমকানে আতিথ্য দানে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমুন্নত করেন। প্রসঙ্গটি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয় আসরা বিআবদিহী’র শব্দমালায়। বান্দা যখন বিনয়ে একেবারে নূয়ে পড়ে তখন তিনি বান্দার মর্যাদা উন্নত করে দেন। আর এ মে’রাজের সফরকালীন আল্লাহ্ তাঁর হাবীব’র উম্মতদের জন্য নামাযকে ঐশী তোহ্ফারূপে নবীজির মাধ্যমে প্রেরণ করেন। আর নামাযের সিজদা শেষে প্রতিটি বৈঠকে বসে আমরা লাÑমকানের খোদা প্রদত্ত শব্দমালায় সে স্মৃতিকে স্মরণ করে থাকি। বোধ করি, নামাযকে ‘মুমিনের মে’রাজ’ বলার মধ্যে এটাও এক কারণ, ‘তাশাহ্হুদ’ মে’রাজেরই স্মৃতিচারণ। অন্য ফরয ইবাদতগুলো বছরে একবার করে পালন করতে হয়। আর নামায দৈনন্দিন পাঁচবার করে পালনীয়।
অনেক নামসর্বস্ব মুসলমান এমনও আছে, যারা ইয়াযীদের এহেন ঘৃণ্য আচরণগুলোকে নির্লজ্জ সমর্থন দেয়, আবার লোক দেখানো নামাযও পড়ে। এ জাতীয় নামায অসার, মূল্যহীন। তারা একটুও ভাবে না যে, নামাযের বৈঠকে দরূদ আদায়ের সময় নবীজির আ’লের প্রতি, আহলে বাইতের প্রতি দরূদ পড়া হয়। সেখানে তো ইয়াযীদের বা তার বংশধরের কথা উল্লেখ করা যায় না। তারা ইয়াযীদের নামেই দরূদ পড়ে না কেন? মায়াকান্না কার জন্য? যাঁদের প্রতি মুমিনের মে’রাজসম ইবাদত নামাযে দরূদ পড়তে হয়, ইমাম হুসাইন তো তাঁদের শীর্ষস্থানীয়। নামাযে আÑলে মুহাম্মদ বা নবীজির পরিবারের প্রতি সালাত প্রেরণের সময় হুসাইন বিদ্বেষী ও ইয়াযীদ প্রেমীদের মনের অবস্থা আদৌ সুখকর নয়। কপট মুসলমান ইসলামে ‘মুনাফিক’ হিসাবে পরিচিত। মুনাফিকদের নামায প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা যখন নামাযে দাঁড়ায়, শৈথিল্য নিয়ে অর্থাৎ অলস ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। এরা লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে, আল্লাহ্কে থোড়াই স্মরণ করে।’ (৪:১৪২) আর আল্লাহ্র ফরমান, ‘তোমরা নামাযগুলো আদায়ের প্রতি যতœবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের ব্যাপারে। আল্লাহ্র সামনে একান্ত নিষ্ঠা ও বিনয়ের সাথে নামাযে দাঁড়াও’। (২:২৩৮)
নিষ্ঠা ও বিনয় সহকারে পাঁচ ওয়াক্ত নামায তাকবীরে তাহরীমাসহ জামাতের সাথে যদি একাধারে চল্লিশদিন যাবৎ আদায় করা যায়, আল্লাহ্র রাসূল’র ইরশাদ মতে ‘তাঁকে আল্লাহ্ তাআলা দু’টি বিশেষ মুক্তি দান করবেন। ১. নরকের আগুন হতে আর ২. নিফাক্ব বা কপটতা হতে। যে ব্যক্তি নিয়মিত জামাতে নামায আদায় করেন, আল্লাহ্ তাঁকে পাঁচটি বিষয় দান করবেন। ১. অভাব দূরীভূত করবেন, ২. কবরের আযাব শিথিল করা হবে, ৩. ডান হাতে আমলনামা প্রদত্ত হবে, ৪. বিজলীর গতিতে পুলসিরাত পার হয়ে যাবে, ৫. ধারণাতীতভাবে জান্নাতে দাখিল হবে। পক্ষান্তরে, যারা এতে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে, তিনি তাদের নয়টি শাস্তি দেবেন। দুনিয়াতে :১. রুজি রোজগার বরকত উঠে যাবে, ২. চেহারা হতে নেকীর আলো চলে যাবে, ৩. লোকের অন্তরে ঘৃণিত হয়ে যাবে। ৪. কবরে : মুনকার নকীরের প্রশ্ন কঠিন হবে, ৫. কবর অন্ধকার ও ৬. সংকীর্ণ হবে। ৭. কিয়ামতে : হিসাব কঠিন হবে, ৮. শরীর ঘর্মাক্ত হবে এবং ৯. পুলসিরাত পার হওয়া কঠিন হবে। আমাদেরকে নিষ্ঠার সাথে নামায প্রতিষ্ঠায় যতœবান হতে হবে।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা। খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।