মোহীত উল আলম »
৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা টানা চারবার এবং মোট পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করার পর জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ২৫ মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রী সহকারে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করে শপথ গ্রহণের পর তাঁর নেতৃত্বের প্রতি জনমানুষের আস্থার সাথে সাথে মিশ্রিত হয়েছে প্রত্যাশা। ব্যাপারটা হচ্ছে, কিছু না পেলে, মানুষের প্রত্যাশা থাকে না, কিন্তু কিছু পেলে প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। জাতি পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গপথ, মেট্রো রেল, পারমানবিক চুল্লী, এবং স্যাটেলাইট রকেট যেমন পেয়েছে তেমনি পেয়েছে আশ্রায়ন, বৃদ্ধ ভাতা, জাতীয় পেন্শন স্কিম, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ সহ নানান বৃহৎ ও ক্ষুদ্র কর্মের সম্পাদন।
এবার জাতির প্রত্যাশা ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় নিয়ে যাবার পথে নানান সংকট প্রধানমন্ত্রী উতরোতে পারবেন, এবং এটির একটি প্রত্যয় নতুন মন্ত্রী সভার গঠনগত চরিত্র দেখলে বুঝতে পারা যায়। বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের সংসদ সদস্যের অন্তর্ভুক্তির ফলে প্রবীণ এবং নবীনের চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে মেলবন্ধনের একটি বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তরুণ মন্ত্রীদের অনেকের বয়স চল্লিশের এ প্রান্তে, ও প্রান্তে। তাঁরা হবেন উদ্যমী ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন, আর প্রবীণেরা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে নবীনদেরকে পথ দেখাবেন।
সংকটের মধ্যে প্রথমটা হলো অর্থনীতি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা, যার আক্ষরিক অর্থ হলো দারিদ্র নিরসনমূলক জোরদার অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করা। এবারের সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বেশ বড় অংশ এসেছে ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকে। দলীয় রাজনীতির মূল লক্ষ্য থাকে একটি আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতি পরিচালনা করা। যেমন সরকারি দলের আদর্শ হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। এই আদর্শের মূল ভিত্তি হলো আত্মস্বার্থ পরিত্যাগ করা। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে আজকের শেখ হাসিনা পর্যন্ত এঁরা এক একটি জীবন কাটিয়েছেন সম্পূর্ণতই বাংলাদেশকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কাজ করতে। কিন্তু ব্যবসার চেহারাটা খানিকটা আলাদা। ব্যবসাতে দেশসেবা, জনসেবা থাকে, কিন্তু মূল লক্ষটা হলো মুনাফা অর্জন। সহজভাবে জিনিসটা বোঝা যায়, যাঁরা সংসদীয় রাজনীতিতে বিজয়ী হোন, তাঁদের সম্পদ দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণতর হয়। এঁদের কাছে রাজনীতি একটা ব্যবসা। ওপরে ওপরে আদর্শের কথা বলে এঁরা, কিন্তু তলায় চোখ থাকে জমি, বাড়ি, জাহাজ, গুদাম, ডলার ইত্যাদি বৃদ্ধিকরণে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। পত্রপত্রিকায় আসে ব্যবসায়ীমহল সিন্ডিকেট তৈরি করে জনগণকে ঠকিয়ে বা ধোঁকা দিয়ে নিজেরা পুরো পেঁয়াজ, ডাল, আটা বা মরিচের বাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। যথেষ্ট সরবরবাহ থাকলেও দাম বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক মূলসূত্রগুলো, চাহিদা-সরবরাহের ক্লাসিক্যাল নিয়ম, এখানে ব্যবসায়ীদের কালো হাতের জন্য কাজ করছে না। অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাতে না পারলে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনে, বিশেষ করে দরিদ্রশ্রেণির জন্য কী যে কেয়ামতের সৃষ্টি হয় এটি ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীপরিষদের কাছে জাতি এই প্রত্যাশা করে যে মানুষের দৈনন্দিন খাওয়া-পরা ও বসবাসের জায়গায় যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
আরেকটি প্রত্যাশা হলো শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি ঘটানো। বাংলাদেশের বাংলাভাষায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষা চালু আছে। এই তিন ধারার মধ্যে বিষয়জ্ঞান, খরচপাতি ও ব্যবহারিক দিক থেকে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও কিন্তু লক্ষ্য একই। সেটি হলো জানা, আর সে জানাকে সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগানো। আঠারো কোটির দেশ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীমহল নিজেই বিরাট একটি জনগোষ্ঠী। এদেরকে জ্ঞান দেবার জন্য, দেশ গঠনে উপযুক্ত নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য নিয়োজিত থাকেন বিরাট এক শিক্ষকগোষ্ঠী। এই শিক্ষকগোষ্ঠীকে উপযুক্ত মান-মর্যাদায় সম্পৃক্ত না রাখলে, শিক্ষা প্রদানে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এদের জন্য যেমন ভালো শিক্ষক হিসেবে গড়ে উঠতে প্রশিক্ষণপদ্ধতি ও গবেষণার দুয়ার উদার করে দিতে হবে, তেমনি বইপুস্তক সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত সাহায্যও বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারের কাছে এদিক থেকেও প্রত্যাশা থাকবে যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে শিক্ষকদের সঙ্গে একটি তুলনামূলক কাঠামোতে যেন বাংলাদেশের শিক্ষকেরা পর্যায়োন্নয়ন, বেতনাদি ও সম্মানের দিক থেকে অধিষ্ঠিত থাকেন। শিক্ষা বলতে এখন ডিজিটাল শিক্ষাকেও বোঝায়। করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন বন্ধ ছিল এবং অনলাইন শিক্ষাপ্রদান চালু হয়, তখন লক্ষ করা গেছিলো যে, শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রদান একই স্তরের হতে পারেনি। এখন করোনা নেই, কিন্তু প্রযুক্তিগত সুবিধা যেন প্রান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও চালু থাকতে পারে সে জন্য বৈদ্যুতিক সরবরাহ কিংবা বিকল্প পন্থাগুলো সক্রিয় করার সর্বোচ্চ সুযোগ সরকার নিতে পারেন। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এ কথাটা এমনি এমনি চালু হয়নি। এটাতো আমরা চাক্ষুষ দেখছি যে যে দেশ যত শিক্ষিত, সে দেশ তত উন্নত। শিক্ষার অর্থ এখানে শুধু প্রয়োগকৃত জ্ঞান নয়, চিন্তাগত শিক্ষাও। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি প্রযুক্তিগত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা দেবার উপযুক্ত আবাসন হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, দেশের মানুষের চিন্তাশক্তিও বাড়বে, কর্মপদ্ধতির কৌশলগত দক্ষতাও বাড়বে। শিক্ষা আদতেই একটি বহুমাত্রিক প্রকরণ। নতুন শিক্ষানীতি নামে শিক্ষার্থীর বহুমাত্রিক সৃজনশীলতার সহায়ক এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে চালু করার আয়োজন চলছে। এটার প্রায়োগিক ফলাফল সামনে বোঝা যাবে।
আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলছি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে লক্ষ করা গেছিলো যে বাংলাদেশকে নিয়ে যেন বিশ্বে দু’টো পক্ষ তৈরি হয়ে গেছিলো। এটা হওয়া অভিপ্রেত ছিল না। কারণ বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত বৈদেশিক নীতিমালাই ছিল ‘কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে মিত্রতা’, তাই এটার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কোন পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয় পররাষ্ট্রনীতি সেভাবেই পরিচালিত হওয়া উচিত। ব্যাপারটা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিশ্বটা ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে খুবই ছোট হয়ে এসেছে তথ্য আদানপ্রদানের দিক থেকে। ‘গ্লোব্যাল ভিলেজ’ কথাটা এখন যথার্থ অর্থেই প্রযোজ্য। করোনার সময় বাংলাদেশ যে অল্পতেই পার পেয়েছিল সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা এজন্যই করতে হয় যে তিনি কোন একটি দেশ বা দুটি দেশ থেকে সৌজন্যমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে করোনার টিকা এনে দেশের জনগণকে বিনা খরচে দিতে পেরেছিলেন, মোট চার দফা। এটি সম্ভব হতো না যদি আমাদের দেশের সঙ্গে ঐসব দেশের সদ্ভাব না থাকতো। আরেকটি কথা হচ্ছে, ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিকভাবে আমরা ইংরেজিভাষা সংলগ্ন দেশগুলোর সঙ্গে শিক্ষা, চাকরি, বাণিজ্য ও সামাজিকতায় বহু যুগ ধরে সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততা আরও বাড়াতে হবে, কমাতে নয়।
চতুর্থ প্রত্যাশা যেটা, সেটা হলো উপযুক্ত প্রতিপক্ষতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় সমাজ বিকশিত হতে পারে না। ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায়, যেদিন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে, টিভিতে সে খবর দেখার সময় দেখলাম নয়া পল্টনে ৭৫ দিন পরে বিএনপির অফিসের তালা ভেঙে নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই ঘটনার পিঠাপিঠি দেখছি দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে ২২৫টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, স্বতন্ত্র ৬২টি এবং অন্যান্য দল ৩টি। জাতীয় পার্টির প্রতিপক্ষতা হলো নির্বিষ, বাকি ৩টারও তাই, কিন্তু ৬২টি বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রাথীর প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই পদবীধারী সদস্য। এঁরা বিরোধীদল হিসেবে মোর্চা বাঁধলেও প্রকৃত বিরোধীদল বলা যাবে না। এঁরা হলেন নৌকার বাইরে নৌকা। তা’তে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বিরোধীদল না থাকলে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিভেদ, মাঠ পর্যায়ে মারামারিতে রূপান্তরিত হতে দেরি হবে না। ’৭৪ সালে মোহসীন হলে ৭ ছাত্রনেতাকে ব্রাশ ফায়ারে খুন করার উৎস ছিল বিবদমান ছাত্রলীগের দুই ফ্যাকশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তার কারণ হচ্ছে, নিজ দলের মধ্যে প্রতিপক্ষতা তো আর আদর্শ নিয়ে হবে না, হবে কাল্ট-কালচার নিয়ে, বিষয়-আশয় নিয়ে, জমিটা নিয়ে, স্কুলটা নিয়ে, ক্লাবটা নিয়ে, ব্যবসাটা নিয়ে, বা কোন কোন ক্ষেত্রে অসদুপায়ে অর্জিত টাকার বখরা নিয়ে। কর্মীদের মধ্যে অমুক অমুক নেতার লোক, তমুক তমুক নেতার লোক, এই সাংর্ঘষিক ঝগড়াগুলো মাইক্রো লেভেলে ক্রমশ বিকশিত হবে। তাই আদর্শগত একটি বিরোধীদল বা জোট থাকা আওয়ামী লীগের জন্যই প্রয়োজন। এটা রাজনৈতিক রিটারিকের জন্যও প্রয়োজন, কেন না সেরকম একটি বিরোধী দল না থাকলে আপনি কথার ফুলঝুরি ফোটাবেন কার বিরুদ্ধে!
পঞ্চমত, জনস্বাস্থ্য ঠিক রাখা সরকারের জন্য সবসময় বিরাট একটা পরীক্ষাগার। সরকারি হাসপাতালে এত রোগীর সমাগম হয় যে স্বাস্থ্যরক্ষার সকল প্রক্রিয়ায় জনসংখ্যার চাপে ব্যাহত হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় রকমের বৈপ্লবিক পরিবর্তন না আনলে, সাধারণ জনগণ সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসার উপকারটা পাবে না। ‘অন্ধজনে দেহ আলো’, এই প্রবচনটি শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও।
নতুন সরকারকে অভিবাদন।
 
				 
		























































