রায়হান আহমেদ তপাদার »
করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বয়স্কদের মধ্যে তবে বয়সে তরুণরাও আর নিরাপদ নন এই ভাইরাস থেকে বিভিন্ন দেশে ক্রমেই অল্পবয়সীদের মধ্যে বাড়ছে সংক্রমণ বাড়ছে ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকা থেকে মৃত্যুহারও। বিশ্বজুড়ে যে গতিতে বেড়ে চলেছে করোনা সংক্রমণ তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা নিয়ে দিশেহারা সব মহলই। দিন যত এগোচ্ছে পরিস্থিতি ততই জটিল হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও এক আশঙ্কার কথা শোনাল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু। সবসময় নিজেকে বদলে চলেছে করোনাভাইরাস। আর সেই পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে যুব সমাজও আর নিরাপদ নয় এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে। এতদিন দেখা যাচ্ছিল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন মারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে যারা মারা যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই অল্প বয়সী। তিরিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশের কোঠায় থাকা ব্যক্তিরা আর নিরাপদ নন এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে।
অন্যদিকে সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তারা বলেছেন অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের এত বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা খুব একটা উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়নি। কমবয়সীদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার দৈনিক তথ্য ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে, তার কারণও তারা বলছেন। কিন্তু সংক্রমণ রোধে তরুণ প্রজন্মের যে বাড়তি দায়িত্ব সেটি তাদের বোঝাতে আলাদা করে প্রচারণার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না।
কোভিড ১৯ সম্পর্কে সচেতনতায় আমরা যে প্রচারণা চালাচ্ছি সেখানে তরুণ প্রজন্মকে বোঝানোর জন্য আলাদা কোন প্রচারণা নেই। আমাদের গোটা কর্মসূচি সবাইকে ঘিরে একসাথে। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইকে আমরা মোটিভেট করার চেষ্টা করছি। তাদের জন্য আলাদা আলাদা প্রচারণা হওয়া উচিত। তরুণদের ওপর কোভিড-১৯-এর মৃদু প্রভাব এবং কোভিড-সংক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তির বর্তমান নিম্নহার আপাতত যে সন্তুষ্টির ভাব তৈরি করেছে তাতে শঙ্কার জন্ম দিতে পারে। ফ্রান্সে কয়েক সপ্তাহ আগে তরুণদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের বর্ধমান হার শনাক্ত করা হয়। এখন ভাইরাসটি জনগোষ্ঠীর অন্যান্য অংশেও ছড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এখন আরো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আগস্টে নতুন সংক্রমণে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেল তার ফলে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি ১৫ শতাংশ বেড়ে গেল। এ ঘটনায় একজন নেতৃস্থানীয় এপিডেমিওলজিস্ট সতর্কবাণী ঘোষণা করলেন, যদি সংক্রমণের চলমান হার অবিবেচিত থাকে, তাহলে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ একটা সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
মিস্টার হ্যানকক ঠিকই আঁচ করেছেন তিনি তরুণসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলে, তারা যেন এমন ব্যবস্থা নেয় যাতে ভাইরাসটি জনগোষ্ঠীর দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। কিন্তু মেলামেশা করা তরুণদের সামাজিকায়নের স্বাভাবিক প্রবণতা। যদি রোগটির অ্যাসিম্পটোমেটিক বিস্তারের পটেনশিয়ালের কথা ভাবা হয়, তাহলে এটাও ভাবা জরুরি যে সরকারকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ব্রিটেনে গত কয়েক সপ্তাহে কভিড-১৯-এর বিপুল হারে নতুন সংক্রমণ ঘটেছে। এটাকে ‘ওয়েক-আপ কল’ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
গ্রীষ্মের পর রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় চলমান জনস্বাস্থ্য সংকটের চেয়ে অর্থনীতির পুনর্যাত্রা শুরু করার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। হেমন্ত ও শীতে আবহাওয়া ক্রমেই শীতল হবে, জীবনযাত্রা আরো বেশি করে গৃহমুখী হতে শুরু করবে। বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশ। যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহের ধূসর স্বপ্ন এড়াতে চায়। এরই মধ্যে মূল চ্যালেঞ্জগুলোর একটি প্রকট হতে শুরু করেছে। তরুণদের মধ্যে বর্ধমান সংক্রমণ হার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগটি ছড়ানোর পথ বিস্তার করার হুমকি দিচ্ছে। সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেছেন, নতুন সংক্রমণের ঘটনাগুলো মূলত অনূর্ধ্ব ২৫ তরুণের মধ্যে ঘটছে, বিশেষ করে ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সীদের মধ্যে। ডজন ডজন স্কুলে যে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তা সবাইকে আরো উদ্বিগ্ন করবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সংক্রমণের ধারায় যে পরিবর্তন ঘটেছে তার সম্ভাব্য অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। তরুণদের মধ্যে সাধারণত কভিডের মৃদু লক্ষণ দেখা দেয় এবং তাদের মধ্যে এই রোগটি অ্যাসিম্পটোমেটিক হওয়ার প্রবণতাই দেখা যায়। বসন্তের শুরুর দিকের উষ্ণ ও শুষ্ক দিনগুলোতে কোভিড-১৯-এর পরীক্ষণ কার্যক্রম মূলত গুরুতর অসুস্থ লোকদের জন্য সীমিত ছিল। এখন যে সংক্রমণ চিত্র দেখা যাচ্ছে, করোনার পরিসংখ্যানে তখন তা দেখতে পাওয়ার অবকাশ হয়তো ছিল না। কিন্তু সংক্রমণের নতুন জনমিতিক চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,এটা এ কারণে ঘটে থাকতে পারে যে প্রবীণ লোকদের ওপর বেশি নজর রাখা হয়েছে। রোগটির ডিফারেনশিয়াল ইমপ্যাক্ট খেয়াল করা হয়েছে। ছোট্ট পরিসরে কয়েক মাস বসবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তরুণদের কেউ কেউ গ্রীষ্মে লকডাউনের বাধ্যবাধকতা ঢিলা করার সুযোগ নিয়েছে; বিষয়টিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লাইসেন্স হিসেবে নিয়েছে তারা। অতঃপর যে চিত্র দেখা গেল তাকে স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা যায় না। শেষ পর্যন্ত সরকারকে সারা দেশে যথাযথ কমপ্রিহেনসিভ কোভিড টেস্টিং রেজিম কায়েম করতে হবে। এ মাসের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করার জন্য সারা দেশের শহরে-নগরে হাজির হবে। ‘দ্য সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর মার্জেন্সিজ গত সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছে, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ‘সিগনিফিকেন্ট আউটব্রেকস’ ঘটার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।এতে সারা দেশেই সংক্রমণের হার বেড়ে যেতে পারে। সংস্থাটি কোভিড-সংক্রান্ত পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।
করোনা ভাইরাস: তরুণরা যেভাবে অন্যদের ঝুঁকিতে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, দেশটিতে তরুণ প্রজন্মের আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। সেখানে ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া ও টেক্সাস সহ আরও কিছু অঙ্গরাজ্যে তরুণদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের বেশি হারে আক্রান্ত হওয়াকে এখন বিশ্বব্যাপী বিশেষ উদ্বেগের সাথে দেখা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ অর্থাৎ সংক্রমণ কমে আসার পর আবার ঊর্ধ্বগতিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারেন কিনা সেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশেও অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই করোনাভাইরাসে উল্লেখযোগ্যভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর তথ্যমতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে এপর্যন্ত শনাক্ত ব্যক্তির ৫০ শতাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৪০ বছর। তরুণরা উদ্বিগ্ন বোধ করছেন না। কারণ তারা দেখছেন যে আক্রান্ত হলেও তাদের উপসর্গগুলো খুব গুরুতর নয়। অনেক সময় তাদের মধ্যে কোন উপসর্গই দেখা যায় না। তারা দেখছে যে মূলত বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। তাই করোনাভাইরাসকে তারা হালকাভাবে নিচ্ছেন। এর ফল হল তরুণরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কম। তারা যে অন্যদের জন্য ঝুঁকির কারণ সে বিষয়ে আলাদা করে কোন প্রচারণা না থাকায় সংক্রমণ রোধে নিজেদের দায়িত্বটুকু তারা বুঝতে পারছেন না। রাস্তায় নামলে দেখা যায় অনেক তরুণ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আড্ডা দিচ্ছেন। কারো মুখে হয়ত মাস্ক আছে, কারো নেই, কেউ আবার মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। তারা বাইরে বের হন বেশি, তাদের মধ্যে রেকলেস হওয়ার প্রবণতাও বেশি। এই তরুণরাই বাড়ি গিয়ে নিজের পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের সংক্রমিত করছেন। পরিবারে আগে থেকেই কারো হার্ট, কিডনির সমস্যা বা ডায়াবেটিস আছে তাদেরকেও বড় ঝুঁকিতে ফেলছেন। বাংলাদেশে এখনো পরিবার গুলোতে বাবা-মা, ভাই- বোন হয়ত অন্য কোন আত্মীয় সবাই মিলে একসাথে থাকেন। বাংলাদেশে কয়টি পরিবার সবার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করতে পারে? স্বভাবতই তরুণদের কেউ বাইরে আক্রান্ত হলে সে বাড়িতে অন্যদের সংক্রমিত করবে। আমাদের সবারই জানা তারুণ্যের একটা চরিত্র রয়েছে। তারা বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করে। হৈ হুল্লোড় তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকায় তারা হয়ত হাঁপিয়ে উঠে বাইরে বেশি বের হচ্ছেন। দিন যত বেশি হচ্ছে, বাংলাদেশ অনেক কিছু শিথিল করছে। তাই সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে শনাক্ত ৫০ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৪০ বছর এই তথ্য আর একটি গুরুত্ব বহন করে। এই বয়সীরাই মূলত পরিবারের অর্থের যোগান দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন বেশি। তাকে চাকরির জন্য, ব্যবসা বাণিজ্য বা পরিবারের অন্যান্য কাজে বাইরে যেতে হয় বেশি। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণে বয়স্কদের অবস্থা বেশি গুরুতর হয় এমন তথ্য জানার পর আমরা কিন্তু আমাদের পরিবারের বয়স্কদের এক অর্থে ঘরে বন্দি করে ফেলেছি। তাদের কাজগুলোও তরুণরা করে দিচ্ছে। যুব সমাজের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে যে তাঁদের উপর এই রোগের তেমন প্রভাব পড়বে না। সেই কারণেই বিষয়টিকে হালকা ভাবে নিচ্ছেন তাঁরা। আর তার ফল ভোগাও এখন শুরু হয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃতদের মধ্যে প্রতি ৬ জনের একজনের বয়স ষাটের নিচে। গত ৫ থেকে ৬ সপ্তাহে দেখা যাচ্ছে ইতালিতে ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের নিচে। তাই বয়স্কদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকলেও বর্তমান সময়ে অল্প বয়সীরাও যে আর নিরাপদ নন সেই তথ্যই উঠে আসছে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক