গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া ♦ কাজী মোস্তাইন বিল্লাব ♦ মোহাম্মদ শাহ্ আলম »
ড. গাজী সালেহ্ উদ্দীন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সুধী মহলে শোক নেমে আসে। প্রফেসর গাজী সালেহ্ উদ্দীন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের দুইবারের নির্বাচিত ডিন। ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (২০০৫-০৬)। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, বিভাগের সভাপতি হিসেবেও কর্মজীবনে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত নানা সংগঠন- প্রজন্ম-৭১, পাহাড়তলী বধ্যভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয় অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে পাহাড়তলী বধ্যভূমি শনাক্তকরণ ও রক্ষার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর পিতা আলী করিম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ হয়েছিলেন। পাহাড়তলীর পাঞ্জাবি লেইন যা বর্তমানে শহীদ লেইন হিসেবে পরিচিত সেখানে তাঁর পরিবার ’৭১ এ বাস করেছিলেন। পিতার মৃত্যুতে তাঁদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা তাঁর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতায় ক্রমশ অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। নিজেও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮৩-২০১৭ সাল পর্যন্ত ড. গাজী সালেহ্ উদ্দীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। একজন গবেষক হিসেবে তিনি ড. অনুপম সেনের নির্দেশনায় পিএইচ.ডি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল সকল আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে সংগ্রাম করে গেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাহসের সাথে সংগ্রাম করে গেছেন গাজী সালেহ্ উদ্দীন।
তাঁর লেখা ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি’ গ্রন্থটি স্মৃতি নির্ভর একটি রচনা। এই গ্রন্থে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির নানা বৈশিষ্ট্য, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন। নিজের মনোবল ও দৃঢ়তায় কীভাবে তিনি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন তা তিনি এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ড. গাজীর অপর গ্রন্থ হলো মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। এই গ্রন্থে তিনি চট্টগ্রাম শহরের বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নানা প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তাঁর পিএইচ.ডি থিসিস ছিল গ্রামীণ সমাজতাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে। এই গ্রন্থে তিনি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজকে স্টাডি করেছেন। ড. গাজীর সর্বশেষ গবেষণা ছিল শমশের গাজীকে নিয়ে। ‘শমশের গাজী’ ছিলেন বর্তমান কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী ভূখ-ের কৃষক নেতা। তাঁকে নিয়ে ইতোপূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোতে যে ভুল তথ্য রয়েছে তা তিনি প্রমাণ সহকারে খ-ন করেন। তিনি একজন সমাজতাত্ত্বিক হলেও বাস্তবে তিনি ইতিহাসের গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রন্থটি লিখেছেন। শমশের গাজীর পুত্র শুয়াগাজী (চৌদ্দগ্রামের একটি বাজারের নাম) ও তাঁর বংশধরদের তিনি শনাক্ত করেন। চৌদ্দগ্রাম ভূমি অফিস ও কুমিল্লা জেলা রেকর্ডরুম ঘেঁটে ড. গাজী শমশের গাজী সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করেন। তাই তাঁর এই গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতেও তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে অনেক কলাম লিখেছেন যা তাঁর রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতাই প্রমাণিত করে। অসুস্থ হওয়ার পূর্বে ১১ জুলাই থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য সিআরবিকে নির্দিষ্ট করায়, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি সক্রিয় আন্দোলন শুরু করেন। নাগরিকদের সংগঠিত করে সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন। এর ফলেই সম্ভবত তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। দুটি টিকা গ্রহণ করেও তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন। যে শহরে তাঁর জীবনের সাতটি দশক কেটেছে সেই শহরে তিনি আর ফিরবেন না। তাঁর স্মৃতিধন্য পহাড়তলী তাঁকে আর হাতছানি দিবে না। মৃত্যু অমোঘ। তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রী, শুভানুধ্যায়ী ও সহকর্মীদের মাঝে গাজী সালেহ্ উদ্দীন চিরদিন বেঁচে থাকবেন। তাঁকে জানাই অন্তিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।