ভূঁইয়া নজরুল »
২০১৩ সালে পশ্চিম ষোলশহর সুন্নীয়া মাদ্রাসা এলাকায় ভূমিকম্প ছাড়াই ছয় তলার একটি ভবন পাশের ভবনের উপর হেলে পড়েছিল। বহদ্দারহাট বড় গ্যারেজ এলাকায় একটি আটতলা ভবন হেলে পড়েছিল। এছাড়া গত শুক্রবার ৬ দশমিক ২ রিকটার স্কেলের শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর হেলে পড়েছে অভিযোগ পাওয়া চকবাজার উর্র্দুগলি, বহদ্দার সাবানঘাটা ও হালিশহর এলাকার ভবনগুলোর উচ্চতা ছয় থেকে আট তলা। ১৯৯৭ সালে ভূমিকম্পে হামজারবাগে একটি পাঁচতলা ভবন একদিকে দেবে মারা গিয়েছিলের ভবনের প্রায় ২২ জন বাসিন্দা। হালিশহর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হেলে পড়েছিল আট তলার দুটি ভবন। অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহরে গত ২০ বছরে যতো ভবন হেলেপড়ার ঘটনা ঘটেছে সব ভবনের উচ্চতা পাঁচ থেকে ১০ তলার মধ্যে। এর কারণ কি? বহুতল ভবনগুলো হেলে পড়ছে না। তাহলে মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলোর ঝুঁকি বেশি?
গত শুক্রবার ভূমিকম্পের পর মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলো শুধু চট্টগ্রামেই নয় ঢাকা শহরেও ঝুঁকিতে রয়েছে। এর কারণ কি জানতে চাইলে দেশের অন্যতম ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আনসারী বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় মাঝারি উচ্চতার (ছয় থেকে ১০ তলা) ভবনগুলোতে বাতাসের গতিবেগ অনুসরণ কিংবা বাতাসকে ভিত্তি করে ভবনের নকশা করা হয় না। যা বহুতল ভবনগুলোতে করা হয়ে থাকে। এ কারণে ভূমিকম্প হলে বহুতল ভবনগুলো বাতাসের কঞ্চির মতো দুলবে কিন্তু ভাঙবে না। বিপরীত দিকে মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলো দুলতে না পেরে হেলে পড়বে।’
তিনি বলেন, মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলোতে ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রার শক্তি যুক্ত করা হয় না। আর এতেই বিপত্তি দেখা দেয়।
ড. মেহেদী আনসারীর বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় গত শুক্রবারের ভূমিকম্পে। নগরীর বহুতল ভবনগুলোতে থেকে যারা ভূমিকম্প অনুভব করেছে তারা দোলনার মতো দুলেছে। কিন্তু ভবনের কিছু হয়নি। এবিষয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থকোয়েক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য এবং বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি)’র উপাচার্য প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘২০১০ সালের আগে আমরা যে সার্ভে করেছিলাম সেখানে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ পেয়েছিলাম। এখন এ সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। আর এতে মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলোই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।’
মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণের পেছনে আরেকটি অন্যতম কারণ হলো লিকুফিকেশন (মাটির নিচের স্তরে তরলীকরণ)। এই লিকুফিকেশনের কারণে চট্টগ্রাম শহরের কিছু এলাকায় বহুতল ভবন গড়ে উঠছে না উল্লেখ করে চুয়েটের আর্থকোয়েক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, হালিশহর ও পতেঙ্গা এলাকায় লিকুফিকেশন সমস্যা রয়েছে। একারণে এসব এলাকায় বহুতল ভবনের সংখ্যা কম। কিন্তু যেসব মাঝারি উচ্চতার ভবন রয়েছে সেগুলো যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে ভূমিকম্পে দেবে যেতে পারে।’
এদিকে নগরীর অনেক ভবন পুকুর বা জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে। পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা ভবনগুলোও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া এ যাবত যতো ভবন হেলে পড়েছে প্রায় সবগুলো ভবন পুকুর পাড়ে বা পুকুর ভরাট করে গড়ে উঠেছিল। একথার সত্যতা স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক যে পুকুর পাড়ে বা জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিতে। আর এসব জায়গায় মাঝারি উচ্চতার ভবনই গড়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হেলে পড়ছেও এসব ভবন। অন্ততপক্ষে গত ২০ বছরের পরিসংখ্যান সেটাই বলছে।’
কি পরিমাণ ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে?
বিশেষজ্ঞদের কথায় মনে হচ্ছে এই শহরের মাঝারি উচ্চতার ভবনগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ভবনের সংখ্যা কতো এবং কোন এলাকায় এসব ভবন রয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরে যেসব ভবন গড়ে উঠেছে সেগুলোর অনেক ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ওই সময়ে ইমারত নির্মাণ নীতিমালায় ভবন তদারকির দায়িত্ব ছিল সিডিএ’র। কিন্তু সিডিএ’র পরিদর্শকদের পক্ষে মাটির স্তরের রিপোর্টের সাথে ভবনের ডিজাইন মিলিয়ে দেখা সম্ভব ছিল না। একইসাথে জনবলের অভাবে সিডিএ কর্তৃপক্ষও তা নিশ্চিত করতে পারিনি। সেজন্য আমরা ২০০৮ বিধিমালা প্রণয়ন করি। আর সেই বিধিমালায় তালিকাভুক্ত প্রকৌশলীগণ ভবনের ডিজাইন নিশ্চিত করেছেন। তাই প্রথম এক দশকের ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিতে। এমনকি বর্তমানে যেসব ভবনে দুর্ঘটনা ঘটছে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে সেগুলো সেই সময়কার।
সেই দশকে কি পরিমাণ ভবন অনুমোদন পেয়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রতি বছর গড়ে ২৫০০ ভবনের অনুমোদন পেয়েছিল। সেই হিসেবে ১০ বছরে প্রায় আড়াইলাখ ভবন। এই আড়াইলাখের মধ্যে ১০ শতাংশ ভবন হয়তো সঠিক ছিল কিন্তু বাকি প্রায় দুই লাখ ভবনই ঝুঁকিতে থাকতে পারে।’
বর্তমানে নগরীতে কি পরিমাণ ভবন রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে সিডিএ থেকে অনুমোদিত ভবনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।
এসব ভবনের ভাগ্যে কি আছে?
সিডিএ’র হিসেবে নগরীর প্রায় দুই লাখ ভবন ঝুঁকিতে থাকতে পারে। কিন্তু এসব ভবনের ভবিষ্যত কি? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে ড. মেহেদী আনসারী বলেন, ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই। ভবনগুলোর ভূমিকম্পের সহনীয়তা রয়েছে কিনা আমরা তা যাচাই করে সেই অনুযায়ী শক্তি বাড়াতে পারবো। এজন্য সিডিএকে নির্দেশনা দিতে হবে যাতে ভবন মালিকরা নিজ উদ্যোগে ভবনের শক্তি সম্পর্কে টেস্ট করিয়ে নেয়।’
এ বিষয়ে চুয়েটের আর্থকোয়েক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘এজন্য প্রথমে ভবনের সক্ষমতা কি আছে তা বের করতে হবে। পরবর্তীতে সেই অনুযায়ী শক্তিমত্তা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তাই ভবন ভাঙার কোনো প্রয়োজন নেই। ’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সিডিএ এমন নির্দেশনা দেবে কিনা জানতে চাইলে সংস্থাটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘হুম, এটা একটা ভাল উদ্যোগ হতে পারে। এজন্য নগরবাসীকে একটি নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। শিগগিরই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম স্বাভাবিকভাবেই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে গত শুক্রবার ৬ দশমিক ২ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর একই এলাকায় গতকাল বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে ৪ দশমিক ২ রিকটার স্কেলের একটি ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই এলাকায় আরো বড় ভূমিকম্প হতে পারে।