কামরুল হাসান বাদল »
১৯৮১ সালে ১৭ মে শেখ হাসিনা যদি বাংলাদেশে ফিরে না আসতেন তাহলে আজ কেমন থাকতো বাংলাদেশ? এই প্রশ্নের উত্তরে আমার ব্যক্তিগত উত্তর হচ্ছে পাকিস্তান আজ যেমন আছে তেমন কিংবা তার চেয়ে আরও খারাপ থাকতো বাংলাদেশ। কারণ ১৫ আগস্টের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছিল বাংলাদেশ। আর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল সে লক্ষযাত্রার পথে প্রথম কার্যকর বাধা ও প্রতিবাদ।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে ঘটলে তাঁর রাজনীতিতে আসার কথা নয়। কিন্তু নিয়তি তাঁকে রাজনীতির এই কঠিন পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশকে পুনঃপরিত্রাণ দিতেই বোধ হয় বাংলাদেশ তাকে ডেকে এনেছিল সেদিন। তিনি যদি সেদিন দেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন তাহলে আওয়ামী লীগ আজ আবার উঠে দাঁড়াতে পারতো না, আজকের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারতো না। আর আওয়ামী লীগ না থাকলে আজকের বাংলাদেশও থাকতো না। ফলে আজ মুক্তিযুদ্ধের যে বাংলাদেশ, একাত্তরের যে বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বাংলাদেশ এবং সবশেষে সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদাশীল যে বাংলাদেশ তাও হতো না।
অন্যরা স্বীকার করুক আর না করুক একদিন ইতিহাস স্বীকার করে নেবে বাংলাদেশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ হাসিনা। অখ-তা আর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অনেকেই গেছেন, অনেকেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু নেতা হতে পেরেছেন একজনই- তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন অনেকে কিন্তু ইতিহাসে বারবার উচ্চারিত হয় চার্চিলের কথা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অনেকে কিন্তু ইতিহাসে বারবার উচ্চারিত হয় আব্রাহাম লিংকনের কথা। ভবিষ্যতের বাংলার ইতিহাসে জাতির পিতার পরে আর একজন নেতার নাম উচ্চারিত হবে বারবার তিনি হলেন শেখ হাসিনা। অনেক প্রধানমন্ত্রী আসবেন যাবেন, অনেকের শাসনকাল আসবে যাবে কিন্তু গত প্রায় ১৫ বছরের শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণকাল হিসেবে লিখিত হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনা কী উন্নয়ন করেছেন, কতটুকু করেছেন তা এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য মনে করছি কারণ তা এখন অনেকটা দৃশ্যমান।
সমস্যা হলো বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। বাঙালি গুণীদের কদর করে না। বেঁচে থাকতে সম্মান দেয় না। মারা গেলে কান্নাকাটি করে। বাঙালিরা হাউমাউ করে কাঁদে আর দুদিন পরে ভুলে যায়। সভ্য দুনিয়ার মানুষেরা অশ্রু সংবরণ করে, ওরা আবেগকে সংযত করে। ওরা বালতি বালতি চোখের জল ফেলে না কিন্তু সম্মানের স্থানে, শ্রদ্ধার স্থলে তারা ঠিক কাজটিই করে। তারা তাদের কৃতী সন্তানদের মনে রাখে। তাদের স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যাপক ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নিয়ে থাকে। ওরা শুধু ব্যক্তি নয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সযতেœ লালন করে, সংরক্ষণ করে। পরবর্তী প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার যাবতীয় ব্যবস্থা করে থাকে।
তবে আমাদের দেশে যে একেবারে হয় না তা নয়। সবাই অকৃতজ্ঞ হলে জাতি হিসেবে, দেশ হিসেবে এতটুকু অগ্রসর আমরা হতে পারতাম না। তবে তার সংখ্যা গৌরব করার মতো বেশি নয়। ভাগ্যিস বাঙালির ঘরে কিছু কিছু বরেণ্য সন্তান জন্ম নিয়েছিলেন যাঁরা এই জাতিটিকে চিন্তা-চেতনা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-মনুষ্যতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাঙালি প্রাতঃস্মরণীয় ওই লোকদের খুব একটা স্মরণ করে না।
দেশি-বিদেশি বৈরী শক্তিকে মোকাবেলা করে শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে তাঁর অনড় অবস্থানকে ধরে রেখেছেন। বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত দেশ ও জাতির পক্ষে তাঁর আন্তরিক অবস্থান তাঁকে আজ অন্যতম বিশ্বনেতার মর্যাদায় আসীন করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রায়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব কর্মকা-ের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে। তিনি জনদরদী ও মমতাময়ী। তাঁর দয়ার্দ্র আচরণে চিরন্তন মাতৃত্বের রূপ পরিলক্ষিত হয় বলেই অনেক দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রদানদের কাছ থেকে তিনি পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তি পেয়ে থাকেন।
কয়েকদিন আগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যখন হাঁটু গেড়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল বা কূটনীতিক আচরণ ছাপিয়ে একজন বর্ষিয়ান রাষ্ট্রনেতার প্রতি একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ রাষ্ট্রনেতার ভক্তি ও শ্রদ্ধাই প্রকাশ পায়। একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ-এর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরকালে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পর্যন্ত হাসিনার প্রতি ম্যাক্রঁর আচরণে সন্তানসুলভ ভক্তি লক্ষ্য করা গেছে।
এসব অর্জনের বিষয়। শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকা যায় বটে তাতে মানুষের ভালোবাসা অর্জন সম্ভব হয় না। শেখ হাসিনা দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন তাঁর সাধাসিধা জীবনযাপন দিয়ে, গরিবের প্রতি তাঁর মমতা ও সহানুভূতি জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। তাই একটানা ১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সামান্যতম কমেনি।
জননেত্রী শেখ হাসিনার আজ ৭৭তম জন্মদিন। এইদিনে তাঁর দীর্ঘ নিরোগ জীবন কামনা করি। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার স্বার্থে, জাতির স্বার্থে তাঁকে অনেক অনেক দিন বাঁচতে হবে।
শুভ জন্মদিন জননেত্রী।