ড. আনোয়ারা আলম »
বর্তমানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ কি আছে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! তবুও দেখি কোনও কোন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের দেয়ালে বা গেইটে ব্যানার – নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। অথচ এটি ওপেন সিক্রেট যে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে আছে ছাত্র সংসদ। এদের কাজ কি? অনেক কাজ সেগুলোর বর্ণনা নাই বা দিলাম। অতীতে ছাত্ররাই ছিল দেশের শাসন ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের অন্যতম অনুষঙ্গ। সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল আমাদের ঐতিহ্য। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ছাত্র সমাজ ও তরুণ তরুণীরা দেশের জন্য লড়েছে ও অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর আগে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে ষাটের আন্দোলন ছিল ছাত্র রাজনীতির সোনালি যুগ। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও ছাত্ররা ছিলেন সামনে। কিন্তু পরবর্তীতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও এরাই রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল। তাদের মধ্যে বিভাজন, মারামারি, হলের রুম দখল নিয়ে কোন্দল এমনকি শিক্ষা প্রসাশনেও তাদের লম্বা হাত।
এছাড়া নানা বাণিজ্য তো আছেই। মনে পড়ে-নব্বই এর মাঝামাঝিতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি বড়ো ছেলেকে ভর্তি করাতে। ও অফিসে আর আমি বাইরে অপেক্ষায়। তখন কয়েকজন ছাত্র নেতা চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো-‘কোন সমস্যা আছে কিনা। তাঁরা কিছু করতে পারবে কিনা’।
এটাই হলো ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব। আমাদের সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কতো উৎসাহ, প্রচার প্রচারণা, হৈচৈ একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। মাঝে মধ্যে দুপক্ষের মাঝে মৃদু তর্ক বা ‘ধর -ধর’ ইত্যাদি বিষয় থাকলেও ফলাফল সবাই েেমনে নিত। এখন সে যুগ হয়েছে বাসী। কোন নির্বাচন নেই কিন্তু চর দখলের মতো অবস্থা আছে। এতে কতো নিরীহ ছাত্র যে বলি হচ্ছে। অনেকে হলে না থেকে বাইরে থাকে।
আর পরম বেদনার হলো- অনেক শিক্ষকও এদের ব্যবহার করেন। এর চাইতে বেদনার আর কি হতে পারে।
এর নেতিবাচক পরিণতি হচ্ছে মেধা পাচার। অভিভাবকেরা যেভাবে পারেন দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের মেধাবী সন্তানদের। দেশ ধীরে ধীরে মেধা শূন্য হচ্ছে।
এখন যুক্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাটাকুটি। অনেক অভিভাবক আস্থা হারিয়ে সর্বস্ব দিয়ে ব্রিটিশ ক্যারিকুলামে পড়াচ্ছেন শুধু বিদেশে পাঠিয়ে দেবার জন্য। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্র রাজনীতির উগ্র আচরণের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।
অথচ সব ছাত্রই কল্যাণদর্শী। সমাজের অনাচার বা অসঙ্গতিতে তাদের মন থাকা দরকার স্পর্শকাতর। নবীন প্রবীণের বিরোধ থেকেই তো ছাত্র রাজনীতির সূচনা। অতীতের ইতিহাস তো সাক্ষী।
একালে সমাজনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। এই ঝড়ো হাওয়ায় কিছু ছাত্র সমাজের মানসলোকে এক ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন। শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠেছে খেলার মাঠে। যা এক অশনিসংকেত। ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা তৈরি হয়- যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতার যে শূন্যতার ইঙ্গিত তা কিন্তু কোনভাবেই শুভ নয়।
তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি ছাত্র রাজনীতি দরকার। তবে অতীতের মতো সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। যাদের ভেতরে থাকবে মৌলিক ও শিক্ষামূলক চিন্তার চর্চা। সুস্থ, চিন্তাশীল, বুদ্ধিনির্ভর ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শ। যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তি হবে মননশীলতা,সমাজ,পরিবেশ, ইতিহাস ও দর্শন। এজন্য শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব হিসেবে ব্যবহার না করে দলমত নির্বিশেষে সবার উচিত রাজনীতির তাত্ত্বিক আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। দেশসেবা ও জনসেবার বিষয়ে তাঁদের নিবেদিত করে গড়ে তোলা।
ছাত্ররাই তারুণ্যের প্রতীক। তাদের মেধা, উদ্দীপনা, প্রবল প্রাণাবেগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে দেশপ্রেম। একই সাথে সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে ভেতর শুভবোধ ও সুন্দরের পথে নিয়ে আসতে হবে। সংস্কৃতির সাধনা সুস্থ জীবন চেতনা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। জীবন ও সংস্কৃতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রেক্ষিতে বলা যায় জ্ঞান সাধনার প্রতিফলন ঘটে।
এক্ষেত্রে শিক্ষকেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর। সুতরাং নিজেকে নিরপেক্ষ রেখে ছাত্রদের সঠিক শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের। সুতরাং তাঁরা ও দলনিরপেক্ষ হবেন। নিজেদের মধ্যে দলাদলি বা বিভেদ না রেখে ছাত্রদের সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্য কর্মীদেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে সঠিকভাবে। যে কোন ধরনের সাংস্কৃতিক বিভাজন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বা সঠিক নয়। মনে রাখতে হবে এ দেশ আমাদের। সুতরাং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের ও আছে।
আমরা তরুণ সমাজ বা ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে থাকুক, এটি আমরা আর চাই না। নতুবা দেশ যে সঠিক রাজনৈতিক আদর্শে এগুবেনা এটি আমাদের মনে রাখা দরকার।