তাসকিনা মইজ »
শিশুর মানসিক বিকাশ অতি প্রয়োজন। মানসিক বিকাশের সাথে দৈহিক ও সামাজিক বিকাশ বিশেষ ভাবে জড়িত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশুর সার্বিক বিকাশের একটি উর্বর স্থান। করোনা কালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু কিশোরদের মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে এক শিশুর মানসিক অবস্থা তুলে ধরছি। আজ এক শিশুর আত্মকাহিনী বলতে এসেছি। তার মনের ভেতর পুরো তো ঢুকতে পারিনি যতটুকু তাকে বুঝেছি তাই লিখছি। শিশুটি আমার প্রতিবেশীর। বয়স নয় অথবা সাড়ে নয়। ক্লাস টুতে পড়ে। প্রতিদিন সে সন্ধ্যাবেলা পড়তে যায় তার শিক্ষকের কাছে। হঠাৎ আজ তার মা শিক্ষকের বাসায় উপস্থিত হয় কিছু ফল নিয়ে।বিভিন্ন কথোপকথনের মধ্যে মা শিক্ষককে জিগ্যেস করে তার শিশুটি কোথায়? শিক্ষক বললেন, সে তো আসেনি। মা অবাক বললেন, আমি তো প্রতিদিনের মতো তাকে তৈরি করে আপনার কাছে পাঠিয়েছি। শিক্ষক আরো অবাক হয়ে বললেন, আমি দীর্ঘ একমাস তাকে দেখিনি। মা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ও তাহলে গেল কোথায়?শিক্ষক বললেন, গতকাল ওকে দেখলাম স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে, জিগ্যেস করতেই বললো পড়তে। মা বললেন, না আমি তো তাকে আপনার কাছে পাঠাই।এই বলে মা দৌড় দিলেন রাস্তায়, খুঁজে পেলেন তার শিশুকে।
শিশুটিকে মা আবার শিক্ষকের নিকট পাঠালেন,কিন্তু শিশুটি এবারও শিক্ষকের নিকট আসলো না।অন্ধকারে ছাদে গিয়ে আত্মগোপন করলো। অনেক খোঁজার পরে শিশুটিকে আবার উদ্ধার করা হলো,এবার সে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বাতি বন্ধ করে বসে রইল। অনেক ডাকাডাকির পরেও শিশুটি দরজা খুললো না। পরে তার মা উপায় না পেয়ে আমার কাছে আসলেন, কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করলেন তার বাসায় যাবার জন্য। আমি গেলাম তার বাসায়। দু-তিনটা টোকা দিয়ে বললাম, দরজা খোলো তোমার বর্ষা আন্টি এসেছি। কেন জানি না শিশুটি দরজা খুলে দিয়েই জড়িয়ে ধরলো, সে কাঁপছে। পূর্বের কিছু প্রশ্ন না করে তার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম, দুষ্টুমি করলাম, বেসুরো কণ্ঠে গান গাইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিল তোমার?সে যা বললো, কষ্ট লাগল। তার কথা ছিল আমার ঘরে ভাল লাগে না আর। পড়তেও ইচ্ছে করে না। বাসায় সারাদিন আম্মু পড়ায়, বিকেলে হুজুর সন্ধ্যায় টিচার আর সকালে জুমক্লাস। ভালো লাগে না।আমি স্কুলে যাবো, যেতে পারি না। খেলতে পারি না, আমার কোন বন্ধু নাই, মোবাইলে গেমসও ভালো লাগে না।দাদু বাড়িও যেতে পারি না। এটা শিশুটির আত্মকাহিনী। শুধু এই শিশুটি নয়, আরো অনেক শিশু আছে যারা সবুজ চাইছে।প্রজাপতির মতো উড়তে চাইছে। আকাশে ডানা মেলতে চাইছে। বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতে চাইছে।আমরা যান্ত্রিক দুনিয়াতে আবদ্ধ। কিছুটা আনন্দ অন্তত তারা স্কুল প্রাঙ্গণে এসে পেত সেটাও আজ দেড়বছর বন্ধ।লকডাউন থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে শিশুদের পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা মায়েরা জোর করে খাবারের মতোন তাদের শিক্ষাটাও গিলাচ্ছি। একবারও ভাবছিনা ওদেরও ইচ্ছে আছে,মতামত আছে। নিষ্ঠুর করোনার চাইতেও আমরা তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করছি। আমার প্রজাপতি আকাশে তাদের ডানা মেলতে চায়। স্কুল খুলে দিক আজ আমি মন থেকেই বলছি। একটা জাতি তত বেশি উন্নত হয় যত বেশি তার সুশিক্ষার শক্তি থাকে কিন্তু আমি আজ বলবো জাতি সুশিক্ষিত আর শক্তিশালী তখনই হবে যখন আমাদের সন্তানগুলো সুস্থ, স্বাধীন, হাসিখুশি জীবন পাবে। প্রেসার দিয়ে তাদের কাছ থেকে হয়তো এ+পাবেন কিন্তু মানুষ হিসেবে যে মানসিক গুণাবলির প্রয়োজন তা হয়তো পাবেন না। তাই এ+ নয়, শিশু ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ওদের বেশি বেশি ভালোবাসুন। রিমোট, মোবাইল, ট্যাব না দিয়ে নিজেই কিছুটা সময় খান, খেলেন তার সাথে। তার সুস্থ মস্তিষ্ক তৈরিতে আমাদের ভূমিকা যে বেশি প্রয়োজন। শিশুদের একটু সময় দিন, লেখাপড়াটা চাপিয়ে দেবেন না। সন্তানগুলো আমার, আপনার, আমাদের সকলের। আমাদের দেশেরই সম্পদ। আল্লাহর দেয়া সব চাইতে বড় নেয়ামত।
লেখক : প্রাবন্ধিক