নিজাম সিদ্দিকী »
এক সময়ের আলোচিত ও জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা ইমরান খান রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার পর থেকেই নানা অঘটন তাঁকে ঘিরে রেখেছে। অবশেষে ইসলামাবাদ থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত অ্যাটক শহরের একটি কারাগারে ইমরান খানের ঠাঁই হয়েছে।
গত শনিবার দুর্নীতি মামলায় তিন বছরের কারাদ-ের পর পাকিস্তানের লাহোর থেকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ইসলামাবাদের একটি আদালত তোশাখানা মামলায় ইমরান খানকে দোষী সাব্যস্ত করে এ রায় দেন।
কারাদ-ের পাশাপাশি ইমরান খানকে এক লাখ রুপি অর্থদ-ও দিয়েছেন আদালত।
ইমরানের বিরুদ্ধে তোশাখানার মামলাটি করে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। এ মামলায় ইমরানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রির অভিযোগ আনা হয়।
এভাবে মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায় ইমরান খানের পক্ষে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অনেকটই অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। কারণ পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারান।
২০১৮ সালে ইমরান খান নির্বাচিত হওয়ার পর চার বছরেরও কম সময় ক্ষমতায় ছিলেন। সংসদীয় অনাস্থা ভোটে গতবছর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ এবং হত্যায় মদদ দেওয়াসহ প্রায় ২০০টি অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
গত কয়েক মাসে ইমরান খানের দল ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) ছেড়েছে অনেকে এবং দলের অনেকে আটক হয়েছে।
সব মিলিয়ে ইমরান খানের অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ছে ক্রমশ। তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারক পর্যায়েও খুব আশাব্যঞ্জক ভাবা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিষয়ে পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘দ্য নিউজ’-কে বলেছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা ইমরান খান ও অন্যান্য রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়।
মন্ত্রণালয় ভাষ্য, ‘আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পাকিস্তানি আইনের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানাই। (আমাদের) এই দৃষ্টিভঙ্গি সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।’
যদিও ইমরান খান ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সরকারকে উৎখাত করেছে। প্রতিবারই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের দাবিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে অভিহিত করেছে।
ইমরান খানের মামলায় আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইমরান খান ইচ্ছাকৃতভাবে ইসিপিতে (তোশাখানা উপহারের) জাল বিবরণ জমা দিয়েছেন। দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে নির্বাচনী আইনের ১৭৪ ধারার অধীনে তিন বছরের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকেও গভীর বিদ্বেষের আভাস পাওয়া যায়। সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দেওয়া এক বক্তব্যে সেদেশের তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আজ একজন চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বরাবরই দেশটির সেনাবাহিনী সরাসরি কিংবা নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে করে। এমনকি ইমরান খান ক্ষমতাসীন হওয়ার ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছিল বলে ভাবা হয়। যদিও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কাছে উভয় পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি বিবিসি হার্ডটক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ‘প্রচ- ভীত’ হয়ে পড়েছে।
এসময়ে তিনি বলেন, ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) পাকিস্তানের একমাত্র দল যেটি সামরিক একনায়কদের দ্বারা তৈরি হয়নি। আর এ কারণেই দলটি ভেঙে দিতে তারা তৎপর হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত করে তিনি এও বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারীদের আশা ছিল তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর তাঁর দল দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক উপ-নির্বাচনে তার দলের অভাবনীয় জয় তা মিথ্যে প্রমাণ করেছে বলে তাঁর বিশ^াস। আর সে কারণেই তাঁর দৃঢ় বিশ^াস, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই কেবল স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।
কিন্তু আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও ইতিমধ্যে নানা জল ঘোলা হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যাচ্ছে। সেরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রশাসন।
আগামী ১২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের ক্ষমতাসীন জোটের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর কাছ থেকে দায়িত্ব নেবে। তবে শরিফ তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিন আগে ৯ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার সম্প্রতি জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সর্বশেষ জনসংখ্যা শুমারির জন্য নতুন নির্বাচনী এলাকার সীমানা তৈরি করতে প্রায় চার মাস সময় লাগবে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা কুনওয়ার দিলশাদ প্রায় একই মতামত ব্যক্ত করে রয়টার্সকে বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, অর্থাৎ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির আগে নির্বাচন করা যাবে না।
এদিকে, শনিবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইমরান খানের একটি ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (আগে টুইটার নামে পরিচিত) এ প্রকাশ করা হয়। সেখানে তিনি তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বার্তা যতক্ষণে আপনাদের কাছে এসে পৌঁছাবে, ততক্ষণে তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে থাকবে। আমার শুধু একটাই অনুরোধ ও আহ্বান, আপনারা চুপচাপ বাসায় বসে থাকবেন না।’
‘এটা ন্যায়বিচার, আপনাদের অধিকার, আপনাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। শরীর থেকে শৃঙ্খল নিজে নিজে খসে পড়বে না, সেগুলোকে ভেঙে ফেলতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালিয়ে যান।’
এখন দেখার বিষয়, আদতেই কি এসব আন্দোলন- বিক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে ইমরান খান নির্বাচনী দৌড়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারবেন?