রতন কুমার তুরী »
সাম্প্রতিক কোভিড ১৯ এর কারণে বন্ধ থাকা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার জন্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে, কিছু বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এ বিষয়ে আন্দোলন পর্যন্ত করতে দেখা গেছে।
শনিবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী ৩০মার্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসব ক্লাসে পাঠদানে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রথমে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে আর বাকি শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ১দিন করে ক্লাস করবে।
কয়েকদিন পর থেকে সপ্তাহে দু দিন করে ক্লাস হবে। পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিক অবস্থার দিকে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পর্যালোচনা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ছুটি থাকায় রোজার ছুটি কমবে, রমজানের মধ্যে ক্লাস নেওয়া হবে। শিক্ষকÑকর্মচারীদের টিকাদান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম এ সময়ের মধ্যে শেষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু হবে ২৪ মে’র পর অর্থাৎ ঈদের পর। ইতিমধ্যে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত শিক্ষক কর্মচারীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার আগেই দেশের সকল শিক্ষক-কর্মচারীরা করোনা টিকা পেয়ে যাবেন । প্রকৃতপক্ষে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ বিপুল শিক্ষার্থীদের কোভিড’ ১৯ থেকে সুরক্ষিত রাখতে সরকার বিগত ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বন্ধ রেখেছে। তবে সম্প্রতি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের জন্য কিছু গাইডলাইন প্রকাশ করেছে এবং সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিকভাবে পালন করার জন্য শিক্ষা কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন। সম্ভবত তাদের রিপোর্টের জন্যই সরকার অপেক্ষা করছে। মাঠ পর্যাায় থেকে ‘দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত’ এমন রিপোর্ট আসলেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেবে। ইতিমধ্যে সরকার করোনার জন্য সঠিক সময়ে পরীক্ষায় বসতে না পারা এইচএসসি শিক্ষার্থীদের অটো পাস দিয়ে দিয়েছে এবং বাদবাকি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে প্রমোশন পেয়েছে।
খুব সম্ভবত সরকার পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে আরেকটি অটোপাস এবং অটোপ্রোমোশনের দিকে পা বাড়াবে না।
ফলে সবকিছু মাথায় রেখে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সকল সময়ে, এতে কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সকলের দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুললে সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও কিছু দায় রয়েছে, যেহেতু এখনও করোনাকাল চলছে ফলে শিক্ষার্থীদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ কোভিড সুরক্ষা জিনিস দিয়েই অভিভাবককরা তাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন। এ বিষয়ে যেনো তারা সামান্যতম শিথিলতা প্রদর্শন না করেন। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে যে করোনা টিকা এদেশে আসলেও সব মানুষকে এর আওতায় আনতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, আর এই সময়টাতে যেনো শিক্ষার্থীরা নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকে সে বিষয়ে সব অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে।
করোনাকালীন শিক্ষাবর্ষের (২০১৯-২০২০শিক্ষাবর্ষ) এইচএসসি শিক্ষার্থীদের অটোপাস পাস দেয়া হয়েছে এবং উক্ত শিক্ষাবর্ষের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সবাইকে উচ্চ শ্রেণিতে প্রোমোশন দেয়া হয়েছে তার জের ধরে তাদের পরবর্তী বছরের ( ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপঞ্জিতে কয়েকটি শ্রেণির সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। সরকার সম্ভবত অন্যান্য দেশের মতো একবার খুলে শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ ঘোষণা করতে চাইছে না, আর তাই তারা পরিস্থিতি দেখেশুনে একেবারেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দিতে চাইছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ খুলে দেয়ার আগে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিভাবকদের জন্য সরকারিভাবে কিছু কোভিড সুরক্ষা সামগ্রী যেমন, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, মাস্ক পাঠানো দরকার এতে করে কোনো শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে না আসলে তাদের তৎক্ষণাৎ দেয়া সম্ভব হয়। সকল সময়ের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি পালনের ওপর জোর দিতে হবে।
অন্যদিকে সরকার, অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদেরও কিছু দায় রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের কোভিড সুরক্ষা বিষয়ে তাদের প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে সচেতন করতে হবে প্রয়োজনে এবিষয়ে শ্রেণিকক্ষে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হবে। শিক্ষকরা চাইলে তাদের অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠানে ঘরোয়াভাবে ডেকে এনে তাদের সন্তানদের সুরক্ষা বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন। প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর শিক্ষার্থীদের দায়দায়িত্ব সরকার, শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও নিতে হবে। অভিভাবকরা যদি নিজেরা সচেতন হয়ে তাদের সন্তানদের কোভিড সচেতন করতে পারে তাহলে আমরা সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোভিড সুরক্ষিত থাকবো এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদানে বিঘœ ঘটবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের কোভিড সুরক্ষা বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হই এবং অন্যকেও সচেতন করি আর এ সচেতনতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সাথে সাথেই যেনো শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করতে পারে সে বিষয়ে সজাগ হই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার ব্যাপারেও সরকারের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ঈদ-উল-ফিতরের পর মে মাসের শেষ দিকে খুলবেÑ-ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি। তার সপ্তাহখানেক আগে হলগুলো খুলে দেওয়া হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা গ্রহণ, স্থগিত আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের পরীক্ষা চলবে-এমন সব ঘোষণায় মন্ত্রণালয় সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ-প্রতিবাদও হয়েছে।
এটা ঠিক যে, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মানসিক হতাশায় ভুগছে। করোনা পরিস্থিতি অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে অসহায় করেছে। অর্থনৈতিক অ-নিরাপত্তা তাদের গ্রাস করেছে। শিক্ষার্থী সন্তানদের মধ্যেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তদুপরি অনেকের চাকরি বয়স পেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। সেশন জটও হতে পারে বিভিন্ন বিভাগের। ফলে শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হতে পারে যা অনেক অভিভাবকের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা, যথারীতি নেওয়া, পরীক্ষার ফল প্রকাশ যাতে দ্রুত সময়ে করা যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে কর্তৃপক্ষের।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক