সুভাষ দে »
করোনা কালের ৬ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময় অসংখ্য বিষাদগাথা রচিত হয়েছে আমাদের দেশে। করোনায় আমাদের জীবনÑযাপন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবকিছু বিপর্যস্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসে সোমবার পর্যন্ত ৪ হাজার ৭৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চীনের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। চীনে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪ হাজার ৭৩৪ জন (তথ্যসূত্র : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়)। মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশ বিশ্বে ২৯তম। শনাক্ত ৩ লাখ ৩৯ হাজার ছাড়িয়েছে। সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৪তম। মৃত্যু ও আক্রান্তের হারে শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এরপরই রয়েছে ব্রাজিল ও ভারত। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ, প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ১৮ মার্চ। প্রথমে সংক্রমণ ধীরগতিতে হলেও জুনে সংক্রমণ তীব্র হয়ে ওঠে। এখন চলছে কমিউনিটি সংক্রমণ। এখন সংক্রমণের হার কমলেও মৃত্যু ৩৫-৪৫ এর মধ্যে ওঠানামা করছে। জনসংখ্যা হিসেবে এই হার কম হলেও পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে। কোভিড মহামারি প্রতিরোধে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত আচরণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক আচরণ-এসব ব্যাপারে আমাদের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। করোনার এই কালে আমরা দেশের যশস্বী ব্যক্তিত্ব ও প-িত ড. আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীসহ শিল্প-সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র জগতের অনেককে হারিয়েছি। বেশ কজন রাজনীতিবিদ ও করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। করোনা প্রতিরোধের সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যোদ্ধাদের আমরা হারিয়েছি। সরকার ও দেশবাসীর কর্তব্য হবে, জনগণের সেবায় উৎসর্গিত এসব প্রাণের প্রতি সম্মান জানানো। তাদের পরিবারদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের কথা সরকার বলেছে, এটি যেন যথাসময়ে তারা পায়।
চীনের উহান প্রদেশে গত বছরের নভেম্বরে কোভিড সংক্রমণের পর তা এ বছরের প্রথমদিকে ইউরোপে ও আমেরিকায় করোনা মহামারিরূপে দেখা দেয়। আমাদের দেশে মার্চ/এপ্রিলে মাসে সংক্রমণ শুরু হয়। প্রথমে সময় পাওয়া গেলেও আমরা কিভাবে এর মোকাবেলা করবো ভেবে উঠতে পারিনি। বিদেশ থেকে যারা এসেছেন, যাদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ দেখা গিয়েছিলো তাদের আলাদা করতে পারিনি। এটি ছিলো দুর্বলতা। প্রথমদিকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রয়োজন অনুসারে ও সঠিকভাবে সরবরাহ করা যায়নি। এর ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথম প্রতিরোধেই আক্রান্ত ও অনেকে মৃত্যুবরণ করেন যা অতিশয় দুঃখজনক।
করোনার ৬ মাসের অভিজ্ঞতার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার। বিশেষ করে স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই খাতটির ওপরই কোভিড প্রতিরোধ এবং মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি নির্ভর করে। গত ৬ মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর জন আস্থার পরিচয় দিতে পারেনি। সমন্বয়হীনতা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে বহুল আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। কোভিড মহামারি প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্যবিদ, প্রবীণ চিকিৎসকদের নিয়ে যে কাজ শুরু করার কথা, প্রথমে তা মোটেও হয়নি। কারিগরি পরামর্শক কমিটি হয়েছে অনেক দেরিতে। তারপরও কমিটির পরামর্শ, মতামত প্রায়ই উপেক্ষিত থেকেছে। এখনও পরামর্শক কমিটি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে সমন্বয় নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে মহামারি একদিন থেমে যাবে এরকম একটি মনোভাব স্বাস্থ্য প্রশাসনে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, করোনা সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এখনো টিকা, ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তদুপরি প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর যে বিরূপ রূপান্তর, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার, খাদ্যে অতিরিক্ত রাসায়নিকের প্রয়োগ জীবনযাত্রাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। বিশ্বের সকল দেশকে এ ব্যাপারে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য কষ্টের দিনকাল চলছে, যতই দিন যাচ্ছে করোনার অভিঘাতে জীবনযাপন-অর্থনীতিতে ক্ষতসমূহ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। করোনার আগে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো ২২/২৩ শতাংশ মানুষ এখন তা দ্বিগুণ হয়েছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কর্মহীনতা প্রকট হচ্ছে দিনদিন। ছাঁটাই, বেতন কমে যাওয়া, সেই সাথে জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি এসবের কারণে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে মানুষ অসহায় বোধ করছে। শহরের নি¤œবিত্ত, গরিব মানুষ, নি¤œআয়ের ছোট ছোট পেশাজীবী, দিনমজুর, বাসার কাজের লোক, রিকশাÑভ্যান চালক, ফুটপাতের দোকানদার-গ্রামের পথ ধরছে। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কোনোরকমে দিনযাপনের হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। শখ-আহ্লাদ, বিনোদন, সামাজিকতা এখনও উধাও। অপুষ্টি গ্রাস করছে পরিবারের সদস্যদের। গ্রামীণ-অর্থনীতিতেও ধস নেমেছে, বিশেষ করে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প, মাঝারি শিল্প প্রায় অর্ধেকই বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধের পথে। গ্রামীণ ছোট পেশাজীবীরাও এখন তীব্র সংকটে দিশেহারা, সরকারের কোনোরূপ সাহায্য তাদের হাতে যায়নি। মহামারি কবে যাবে কেউ বলতে পারছে না। এক অনিশ্চিত, আশাহীন জীবনে পা রাখছে, গ্রাম শহরের গরিবÑনি¤œবিত্তÑমধ্যবিত্ত।
বেশি ক্ষতি শিক্ষার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ, কবে খুলবে বলা যাচ্ছে না। ইউনেস্কো বলছে বাংলাদেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থী সংকটে। এই সময় ঝরে পড়াও বাড়বে, দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতার কারণে। করোনার মধ্যে বন্যা অভিশাপ হয়েই দেখা দিয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও কম নয়, এরা গ্রামের সহায় সম্বলহীন মানুষ। কৃষির ক্ষতি হয়েছে বন্যায়, ফলে সবজির দাম অনেকটা নাগালের বাইরে। গ্রামে কাজ নেই, শহরে রোজগারের পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিও সচল হতে শুরু করেছে। তবে এই সময় মানুষকে উঠে দাঁড়াতে আর্থিক নিরাপত্তা, নগদ প্রণোদনা আর কাজের চাকা সচল রাখতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। গ্রামাঞ্চলে মানুষকে কাজ দিতে হবে। কাবিখা, ত্রাণ, স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ, কৃষক ও ক্ষুদ্র, কুটির শিল্পে বিনা সুদে বা একেবারে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। গ্রামও শহরের প্রতিটি মানুষের অবস্থার বিবরণ প্রশাসনের কাছে থাকতে হবে। করোনার সময় কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়নি, বাজার ব্যবস্থা, সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে, তা ছাড়া ব্যাপারি আড়তদাররা না আসায় করোনাকালে কৃষক তার ফসল বিক্রি করতে পারেনি। বাজার ব্যবস্থা ও সরবরাহ চেইন পুনরুদ্ধারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেয়া, কৃষক, ব্যাপারি ও আড়তদারদের প্রণোদনা দিতে হবে। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের উন্মুক্ত মার্কেট প্লেস ‘ফুডফর নেশন’ এর উদ্বোধন করেছেন কৃষিমন্ত্রী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনা সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কৃষকের ক্ষতি ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা (দেশ রূপান্তর, ১৪ সেপ্টেম্বর) করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় প্রণোদনা সুবিধার আওতায় ৪ শতাংশ রেয়াত সুদে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই ঋণ জামানত ছাড়া সরাসরি প্রকৃত কৃষক, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, বর্গাচাষিরা পাবেন ফসল বন্ধকীকরণ চুক্তির মাধ্যমে। এ ছাড়া ফল, ফুল, মৎস্য চাষ ও পোল্ট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদে আরো ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা স্কিম গঠন করা হয়েছে (সূত্র : দেশ রূপান্তর ঐ)
এই সাথে দেশের চর এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর বাঁওড়, পাহাড়ি এলাকার অধিবাসী, দেশের আদিবাসী দলিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে নগদ সহায়তা, স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ, পুনর্বাসন কাজে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এখনো চিকিৎসকরা চেম্বারে কম বসছেন, সরকারিÑবেসরকারি হাসপাতালে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে। দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অক্ষম।
বিশ্ব এমন সংকট কমই দেখেছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা সমাজ, অর্থনীতি, বাণিজ্যÑসবই করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। এই মহামারি প্রতিরোধ ও এর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সদস্য দেশগুলির মধ্যে সংহতি ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করে জাতিসংঘ (সূত্র: প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর)। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, কোনো কোনো দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মহামারির কারণে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারী ও বালিকারা। তাদের উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক কর্মকা- ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দেশে করোনার মধ্যেও অপরাধ কমেনি, নারী নির্যাতনের খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসছে।
আইএলও’র বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংকট ৬ মাস প্রলম্বিত হওয়ায় কাজ প্রত্যাশী বাংলাদেশি তরুণদের মধ্যে ২৪.৮ শতাংশই বেকার হয়ে গেছেন। ২০১৯ সালের হিসাবে তা ছিল ১১.৯ শতাংশ। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়খাতে চাকরির সুযোগ কমেছে। এ সবের অভিঘাত পড়বে পরিবারে।
করোনা কাল কবে শেষ হবে অনিশ্চিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গত রোববার ২৪ ঘণ্টায় একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। ৩ লাখ ৭ হাজার ৯৩০ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এটি ভয়াবহ বিপদের ইঙ্গিত। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সর্বাত্মক হতে হবে, কর্তব্যে অবহেলা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে উদাসীনতা যে কোনো সময় মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। হাল ছেড়ে দেওয়া কিংবা প্রাকৃতিক নিয়মে মহামারি একদিন বিদায় নেবেÑএই মনোভাব থেকে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে সরে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক