ড. খালেদা ইসলাম :
প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ মহামারি অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। যারা বেঁচে গেছেন তাঁদের শরীরেও রেখে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব। এ জীবাণু ক্রমাগতভাবে মিউটেট হওয়ার ফলে পরিস্থিতি দিন কে দিন অবনতি হচ্ছে। বর্তমানে ডেল্টা ভেরিয়ান্ট এবং ডেল্টা প্লাস ভেরিয়ান্ট নতুনভাবে আতংক ছড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভাইরোলজিস্টরা একদিকে যেমন নির্ভরযোগ্য ভ্যাকসিন গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অন্যদিকে তেমনি ইমিউনিটি বা এন্টিবডি বাড়াতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদেরা।
ভাইরোলজিস্ট ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, ভাইরাসজনিত যে কোন রোগের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দরকার এন্টিবডি। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি, সুরক্ষিত থাকার কিংবা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সম্ভাবনাও তার ততই বেশি।
প্রাণঘাতি নভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে সারা পৃথিবীর মানুষ। আগামীকাল কী হবে সে কথা না ভেবে এখন তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা- করোনার সংক্রমণ থেকে সুস্থ থাকতে ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, ফল, টাটকা শাকসব্জি, ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ও মিনারেল আছে- যা প্রাকৃতিকভাবেই দেহে ইমিউনিটি তৈরি করে। এছাড়াও তৈরি করে ‘এন্টিজেন’ – যা করোনার মত ক্ষতিকারক ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি গঠনে সহায়ক।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রোটিনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষায় প্রোটিন কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। দেহে প্রোটিন বা আমিষের অভাব থাকলে জীবাণু খুব সহজেই আক্রমণ করতে পারে। গুণগত ও মানগতা বশিষ্ট্যের দিক থেকে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের তুলনায় প্রাণিজ প্রোটিন রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।
ভারতের প্রখ্যাত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সিদ্ধার্থ জোয়ারদার অধিক পরিমাণে প্রোটিন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অধ্যাপক জোয়ারদারের বক্তব্য হচ্ছে, “শরীরের দরকার প্রাণিজ প্রোটিন। সস্তায় প্রোটিন পাওয়া যায়- মুরগির মাংস ও ডিম থেকে। মাংস না খেলে প্রোটিনের ঘাটতি হবে। তাতে করোনা ভাইরাস শুধু নয়, মানবদেহে অন্য যে কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত প্রোটিন খেতে হবে।”
বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ বলেছেন- “উচ্চ মানের আমিষজাতীয় খাবার যেমন: ডিম, মুরগির মাংস ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল নিউট্রিশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন দৈনিক সমকালকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- প্রাণিজ আমিষ যেমন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে লাইসিন, মিথিয়োনিনসহ বিভিন্ন বায়োঅ্যাকটিভ কম্পোনেন্ট পাওয়া যায়। সিসটেইন ও মিথিয়োনিন রূপান্তরিত হয় গ্লুটাথিয়নে- যা দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
অধ্যাপক আল-মামুন আরও বলেন- ডিমে প্রাপ্ত কলিন এবং ট্রিপ্টোফেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবস্থাতেও মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাবৃদ্ধিতে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, গরুর দুধে প্রাপ্ত প্রোবায়োটিক, ভিটামিন ‘ডি’ এবং ইমুনোগ্লোবিন মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাঁর মতে, করোনায় যেহেতু কোনো কার্যকর চিকিৎসা আপাতত নেই, তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই উত্তম।
অধ্যাপক আল-মামুন জানান, ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি১, বি৬, বি১২সহ ভিটামিন এ, ডি, ই, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে- এখন পর্যন্ত করোনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ছিল দুর্বল এবং তাঁরা বিভিন্ন রোগ যেমন ঠা-া, ফুসফুসজনিত সমস্যা, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সুতরাং করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর এটি সম্ভব বেশি বেশি প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাধ্যমে। সুতরাং বেশি করে ডিম, দুধ ও ব্রয়লার মাংস খাই, করোনার ঝুঁকি কমাই (দৈনিক সমকাল, অন্যদৃষ্টি, ১৮ এপ্রিল ২০২০)।
বয়সকালে শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাদ্য কমিয়ে প্রোটিন গ্রহণ বাড়াতে হবে
প্রোটিন সবসময় সঠিক অনুপাতে গ্রহণ করলে বার্ধক্য জীবনে শারীরিকভাবে অনেক ভালো থাকা সম্ভব। দেহের রোগপ্রতিরোধের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও অনন্য সাধারণ ভূমিকার কাজটি করে থাকে প্রোটিন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে একজন মানুষের হাড়ক্ষয়, বিপাকক্রিয়ার ধীরগতি, দাঁতে সমস্যা, শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ও কোষ্ঠকাঠিন্য নানারকম জটিলতা দেখা যায়। যদিও প্রোটিন-চাহিদা নির্ভর করে মানুষের কাজের ধরণ, ওজন এবং শারীরিক অসুস্থতার উপর, তবুও বৃদ্ধ বয়সে প্রোটিন গ্রহণের মাত্রা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো হতে হবে। যেহেতু এই বয়সে কর্মচাঞ্চল্য কম থাকে। কাজেই এই সময় শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাবারের পরিমান কমিয়ে অধিক পরিমানে আমিষ খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। পেশীর ক্ষয়রোধ ও হাড় মজবুত রাখার জন্য সঠিক পরিমানে প্রোটিন পথ্য হিসেবে কাজে লাগে। এই বয়সে আমিষের অভাব হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নানান ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে দরকার ডিম, দুধ, মাছ ও মাংস
প্রোটিন- কোষ বৃদ্ধিতে এবং দেহ কাঠামো গড়তে সাহায্য করে। শিশুর জন্য প্রোটিনের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে আমিষ অসাধারণ ভূমিকা রাখে। পুষ্টিবিদদের মতে, শিশুদের প্রোটিনের পরিমাণ প্রতিদিন ১৬ গ্রাম থেকে ৬০ গ্রাম হতে পারে। একজন শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিদিন একটি ডিম, এক গ্লাস দুধ এবং একদিন পর পর মাছ ও মুরগি মাংস খাবার তালিকায় রাখতে হবে। আমাদের দেহে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য আমিষের অনেক তাৎপর্য রয়েছে। শিশুদের কোনভাবে আমিষের অভাব হলে নানাবিধ রোগ হতে পারে; যেমন- কোয়াশিয়রকর (শরীর ফুলে যাওয়া, ত্বক শুকনো ও খসখসে হয়ে যাওয়া), ম্যারাসমাস (হাত-পা সরু হয়ে যাওয়া, বৃদ্ধের মতো দেখানো), ইত্যাদি।
তাই সুস্থ যদি থাকতে চান চাহিদা মতো প্রোটিন খান।
লেখক : অধ্যাপক, পুষ্টিও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়