ভূঁইয়া নজরুল »
চট্টগ্রাম কলেজ দেশের সেরা বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে অন্যতম। সচেতন ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই কলেজের রেজিস্ট্রেশনকৃত সব শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকে ছন্দপতন হয়েছে। এই কলেজের মানবিক বিভাগের সাত জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের আওতাধীন অন্যান্য কলেজগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) করেছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৬৬ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করেছে ৯৬ হাজার ৮৩৫ জন। গত ৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয় অনলাইন পদ্ধতিতে ফরম পূরণের সময়। কিন্তু ফরম পূরণ শেষে দেখা যায় অনেক কলেজে ১০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করেনি। শিক্ষার ভাষায় যা ঝরে পড়া হিসেবে বিবেচিত হয়। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের আওতাধীন এবার ২৮৩টি কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
কথা হয় ওমরগনি এমইএস কলেজের অধ্যক্ষের সাথে। এই কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে নিবন্ধিত ( রেজিস্ট্রেশন করা) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৪ জন। কিন্তু এদের মধ্যে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে ১৭০০ জন। নগরীর শিক্ষাজোনের (গণি বেকারি) মধ্যে অবস্থিত কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবারের নিবন্ধিত (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিল ৭১৩ জন। এরমধ্যে ফরম পূরণ করেছে ৫১৮ জন। এতে ফরম পূরণের বাইরে রয়েছে ১৯৫ জন। জাকির হোসেন রোডে অবস্থিত পাহাড়তলী কলেজে এবার নিয়মিত নিবন্ধিত (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিল ৬৫৫ জন, কিন্তু ফরম পূরণ করেছে ৫৫০ জন। নগরীর বাইরে বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম কলেজে ৬৭৫ জন নিবন্ধিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ফরম পূরণ করেছে ৫০৭ জন। কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে নিবন্ধিত শিক্ষার্থী ছিল ৭৭৩ জন। কিন্তু ফরম পূরণ করেছে ৬১৩ জন। ঝরে পড়েছে ১৬০ জন। এভাবে বোর্ডের আওতাধীন প্রায় সব কলেজেই নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের অনেকে ঝরে পড়েছে।
কেন এই ঝরে পড়া?
প্রতিবছরই এইচএসসিতে ভর্তি হওয়া শতভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফরম পূরণ করে না। তবে করোনার কারণে এবারের চিত্র ভিন্ন। এবিষয়ে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর প্রফেসর মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ‘করোনাকালীন প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখার পরও সাত জন শিক্ষার্থীর কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। অর্থাৎ তারা ঝরে পড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, করোনাকালীন আর্থিক সমস্যা কিংবা মেয়েদের বিয়ে ও ছেলেরা কর্মমুখী হয়ে যাওয়ায় এই ঝরে পড়া বাড়তে পারে।
প্রতিবছর সামান্য কিছু শিক্ষার্থী ঝরে গেলেও এবার এই ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি হয়েছে জানিয়ে ওমরগনি এমইএস কলেজের অধ্যক্ষ আ ন ম সারোয়ার আলম বলেন, ‘মূলত করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা ফরম পূরণ করতে পারেনি। অনেক শিক্ষার্থী ফরম পূরণের মাত্র ১১০০ টাকাও দিতে পারেনি। করোনায় অনেক পরিবারের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। আর এর প্রভাব পড়েছে ফরম পূরণে। একইসাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনেক মেয়ে পড়ালেখা থেকে ছুটি নিয়েছে।’
ঝরে পড়ায় মেয়েদের হার বেশি উল্লেখ করে কর্ণফুলী উপজেলার এ জে চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের অনেকে তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর বিয়ে পরবর্তী সময়ে ফরম পূরণ করতে আসেনি।’
একই মন্তব্য করেন বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম কলেজের অধ্যক্ষ সমীর কান্তি দাশ। তিনি বলেন, ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের আধিক্য বেশি। সাধারণত অনেকের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর ফরম পূরণ করেনি। অপরদিকে ছেলেদের অনেককে অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করতে হয়েছে।’
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বক্তব্য
ঝরে পড়ার চিত্র প্রতিবছরই হয়ে থাকে। তবে এবার একটু বেশি মনে হলেও শিগগিরই তা কমে আসবে বলে জানান চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ। তিনি বলেন, এপর্যন্ত ৯৮ হাজার ৮৩৫ জন ফরম পূরণ করেছে। তবে এদের মধ্যে দুই হাজার অনিয়মিত পরীক্ষার্থী থাকতে পারে। সেই হিসেবে নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৬ হাজার ৮৩৫ জন ফরম পূরণ করেছে। আরো হয়তো চার থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে পারে।
সময় তো শেষ তাহলে কিভাবে ফরম পূরণ করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফরম পূরণের জন্য আরো একদফায় সুযোগ দেয়া হবে। এতে আমরা ধারণা করছি নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে হয়তো আরো চার থেকে পাঁচ হাজার ফরম পূরণ করতে পারে। এতে হয়তো ঝরে পড়ার সংখ্যা কমে আসতে পারে।
ঝরে পড়ার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বিয়ে অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর। আর আমাদের ছেলেদের একটি অংশ আর্থিক দৈন্যতার কারণে শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখতে পারে না। এতেই হয়তো ঝরে পড়ছে।
উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষা নিতে না পারায় গত বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণকরা সব শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা দেয়া হয়। এবছরও নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নিতে না পেরে আগামী ডিসেম্বরে শুধুমাত্র ঐচ্ছিক তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এই পরীক্ষার জন্য গত মাসে শুরু হওয়া ফরম পূরণ কার্যক্রম শেষ হয় গত ৫ সেপ্টেম্বর।