নিজস্ব প্রতিবেদক »
জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের চড়া দামের জেরে এমনিতেই নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধও। কাঁচামাল, এপিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রানীতিসহ নানা কারণ দেখিয়ে চট্টগ্রামের ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ঔষধ প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, মূল্য নির্ধারণ তাদের কাজ হলেও প্রচারের দায়িত্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্য নির্ধারণের দায়িত্বও ওষুধ প্রশাসনের। না হলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অধিদপ্তর ও কোম্পানির প্রতি অসন্তোষ তৈরি হবে। সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ওষুধের দাম বৃদ্ধির জন্য ৮ জুন টেকনিক্যাল সাবকমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মানুযায়ী আবেদন করা ওষুধের দাম নির্ধারণ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি অনুসরণ করে ৫৩টি ওষুধের খুচরা মূল্য অনুমোদনের আলোচনা হয়। এরপর ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। সেখানে বলা হয়, এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি কম্বিনেশনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই হিসাবে সাত বছর পর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, ওষুধে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম বাড়ায় এর সঙ্গে সমন্বয় করে ওষুধের দাম কিছুটা ‘আপডেট’ করা হয়েছে।
জুলাই মাসের শুরুতে যে দামে ক্রেতারা বিভিন্ন ওষুধ কিনতে পারতেন এখন তা গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ মূল্য। খুচরা দোকানে দাম ও মানভেদে প্রতি পিস ট্যাবলেটে ১ থেকে ৫ টাকা করে বাড়তি নিচ্ছে। কোনো ধরনের ঘোষণা কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা না হলেও ওষুধের দোকানগুলো নিজেদের ইচ্ছে মত দাম বাড়িয়ে ওষুধ বিক্রি করছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৩০ টাকার প্যারাসিটামল ১০০ এমএলের সিরাপের বোতল এখন ৫০ টাকা, ৮ টাকার ১ পাতা নাপা (ট্যাবলেট) বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়, নাপা এক্সটেন্ড ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা, এনজিলক ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা, এমোডিস ১২ টাকা থেকে ১৭ টাকা, ডিজাইড (এক বক্স) আগে ১০০ টাকা মিললেও এখন তা ৫০০ টাকা, ওসারটিল ৮০ টাকার পাতা এখন ১০০ টাকা, ডিলিটা ৪২ টাকা থেকে ৪৮ টাকা, প্যানটোনিক্স ৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৯৮ টাকা, নাপা ও এইস সিরাপের বোতল ২০ টাকায় আগে বিক্রি হলেও এখন তা ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পাতা অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ আগে কেনা যেত ১৩৫ টাকায় এখন তা ১৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ওরস্যালাইনের মতো অতি জরুরি ওষুধের দাম প্রতি প্যাকেটে ১ থেকে ২ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
হাজারি লেইনের মক্কা ও সেবা ফার্মেসিতে দেখা যায়, ৫০ এমএল এইচ ও নাপা সিরাপে মোড়কে আগের দাম থাকলেও বর্তমানে তা বাড়িয়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আর ৮০ টকার ওসারটিল ৫০ প্লাস ও লোসারটিল ৫০ প্লাস বিক্রি করা হচ্ছে ১০০ টাকায়।
পপুলার ফার্মেসির রাকেশ বিশ্বাস বলেন, কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। ডলারের দাম বাড়ছে, ডলার দিয়ে রাসায়নিক কেমিক্যালসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে হয়, তার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে।
প্রদীপ মেডিকোর শ্রীকান্ত বলেন, কোম্পানি দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। তারা কোন কিছু না বলেই কম্পিউটার বিল হাতে ধরিয়ে দেয়। ক্রেতারাও সারাদিন আমাদের গালি দেয়।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল এর ঢাকা হেড অফিসের (রেগুলেটর) আসাদ রহমান বলেন, প্রকৃতপক্ষে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টগুলো অনেকবছর যাবৎ মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছিল না। এই প্রোডাক্টগুলোর ওভারহেড খরচ এত পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত সম্ভব ছিল ততদিন পর্যন্ত আবেদন করে গেছি। কিন্তু ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আমাদের আবেদন অবহেলা করেছে। এখন শেষ পর্যন্ত যখন সম্ভব হচ্ছিল তারা রিয়েলাইজ করেছে। তাদের অনুমতি ছাড়া বাড়ানো কোনভাবেই সম্ভব না। ওষুধ বিক্রির যে মার্কেট ছিল, তারা দাম বাড়িয়ে নেওয়া অন্যায়। নতুন যে মেডিসিনের দাম সমন্বয় করা হয়, সেটির দাম নিবে।
বাংলাদেশ নাগরিক সমাজ নামক সংগঠনের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তা প্রতিনিধিদের রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা করে না। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই ভোক্তা প্রতিনিধিরা নাগরিক প্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারি না। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে শুনানির মাধ্যমে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করে ওষুধের দাম নির্ধারণ করা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কাঁচামাল, এপিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রানীতিসহ নানা কারণে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকবার ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ওষুধের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন জানান, ওষুধের দাম হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি অনেকদিন হয়নি। কিন্তু কাঁচামালের দাম ঠিকই বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে অনেক ওষুধ মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকদিন ধরেই ওষুধ উৎপাদকেরা দাম বাড়ানোর দাবিটি করে আসছিলেন। সবকিছু ভেবেই দাম একটু হালনাগাদ করা হয়েছে।
ওষুধ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান জানান, ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা তাদের নেই। আবেদন সাপেক্ষে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেয়। আইনকানুন নীতিমালা অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত দেয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্যারাসিটামল ১০টি ও মেট্রোনিডাজল ৬ টি জেনেরিকের দাম বেড়েছে। মেট্রোনিডাজল ২০ মিগ্রা ট্যাবলেটের আগের দাম ছিল ৬০ পয়সা যা বর্তমানে ১ টাকা। অ্যামোক্সিসিলিন ৫০০ মিগ্রা ইনজেকশনের আগে দাম ছিল ২৪ টাকা ১০ পয়সা, বর্তমানে ৫৫ টাকা। এছাড়া জাইলোমেট্রোজালিন, প্রোকলোপেরাজিন মেলিয়েট, ডায়াজিপাম, মিতাইলডোপা, ফ্রুসেমাইড, ফেনোবারবিটাল, ওআরএস, লিডোকেইন, ফলিক এসিড, ক্লোরোফেনিরামিন, বেনজাথিল বেনজিলপেনিসিলিন, অ্যাসপিরিন, ফেনোক্সিমিথাইল পেনিসিলিন, নরগেস্টরল ও ফেরাস সালফেট গ্রুপের মেডিসিনগুলোর দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর সময় থেকে নাপা, ফেক্সোফেনাডিন, অ্যাজোথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিন, জিংক, ভিটামিন সিসহ বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা। বর্তমান জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি দেখিয়ে নিজেদের মত করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।