আ. ফ. ম. মোদাচ্ছের আলী :
মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য, জীবনের সর্বক্ষেত্রে মায়ের ভাষা প্রয়োগের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। ঝরাতে হয়েছে রক্ত এমন নজির পৃথিবীতে নেই। শুধুমাত্র বাংলা ভাষাকেই সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে বাঙালিরা। মা এবং মায়ের ভাষার প্রতি এত্তো ভালোবাসা বাঙালিদের জন্য অহংকারের, গৌরবের। কালপ্রবাহে ফি বছর ফিরে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রতিক্রিয়ার ধূর্ত ষড়যন্ত্র এবং চোখরাঙানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম। এবার ফিরে দেখা যাক ভাষার লড়াইয়ের সেই ইতিহাস।
১৯৪৮ সালে সূচিত ভাষা নিয়ে বিতর্ক শেষ না হয়ে দিন দিন হয়েছে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর। ৪৮ সালের ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি করেছিলেন বাঙলাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়ার। কিন্তু ৫২তে এসে সেই চুক্তির সাথে তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। সাথে সাথে গর্জে উঠলো বাংলার ছাত্র-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী। এর আগেও ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সেটা ছিল মার্চের ২১ তারিখ। সেদিন বাঙলিরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল এই ঘোষণার বিরুদ্ধে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টনে খাজা নাজিম্দ্দুীন কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাকাপোক্তভাবে ঘোষণা দেয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ডাক দিল ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট ও সভার। ঘোষিত হলো ছাত্রসভা, ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল বের হবে ৪ ফেব্রুয়ারি। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরিতে আতাউর রহমান খান-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গঠিত হলো ২৮ জন সদস্যের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সেই পরিষদে মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ ছিলেন আজকের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
৪ ফেব্রয়ারি ছাত্র ধর্মঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হলো ছাত্রসভা। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে রাষ্ট্রভাষা দিবস। আহ্বান করা হয় হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের। এদিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি সাফল্যের সাথে পালিত হয় পতাকা দিবস। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন জোরদার হয়। ঘনিয়ে আসতে থাকে একুশে ফেব্রয়ারি। অন্যদিকে ধীরে ধীরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিনিষেধ বাড়তে থকে। ২০ তারিখ দুপুরে সরকার সভা, সমাবেশ ও মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।
পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সন্ধ্যায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভা বসলো। নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ ভাঙতে চায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ, আইনের বেড়ি। এমনি সিদ্ধান্তহীনতার মধ্য দিয়ে এলো একুশে ফেব্রুয়ারির রাঙা প্রভাত। সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। সকাল ৯টা বাজতে না বাজতে দলে দলে ছাত্ররা এসে জমায়েত হতে লাগলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভায় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্রসমাজ তখন বাঁধনহারা। তারা কোনো বাধা মানতে রাজি নয়। ফলে সিদ্ধান্ত হলো ১০ জন করে একেকটি একটি দল ১৪৪ ধারা ভাঙবে। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে সমবেত হলো মেডিকেল হোস্টেল গেটে। হোস্টেল গেট দিয়ে ১০ জনের এক একটি দল বের হচ্ছে আর গ্রেপ্তার হচ্ছে। সবার মুখে সেøাগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘তোমার ভাষা আমার ভাষা বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’। এরই মধ্যে পুলিশ বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ আর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছে। এদিকে মেডিকেল গেটে ক্রমশ অগ্রসরমান ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা আর সম্ভব হচ্ছে না দেখে পুলিশ সেখানেও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও লাঠিচার্জ করলো। প্রতুত্তরে ছাত্ররাও বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়লো। এরমধ্যে সময় গড়িয়ে যায়। উত্তপ্ততর হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। সময় তখন বিকেল ৩টা। ছাত্রদের ইস্পাতকঠিন মনোবল দেখে বিচলিত হয়ে গুলি ছুড়লো পুলিশ। মেডিকেল হোস্টেল সংলগ্ন ১১ নম্বর ব্যারাকের কাছে ঘাতকের সেই গুলি এসে বুক চিরে দিয়ে গেলো আবুল বরকতের। রক্তাক্ত হলো রাজপথ। রক্তাক্ত হলো ইতিহাস। এরই মধ্য গুলিবিদ্ধ হলেন সালাহউদ্দীন। একে একে রফিক ও জব্বার। পৃথিবী দেখলো বাঙালি প্রাণ দিলো মায়ের জন্য, মায়ের ভাষার জন্য। বাতাসে খবর ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। বিকেলে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সভায় চলে উত্তপ্ত বিতর্ক। ছাত্রজনতা মিছিল করে যেতে চায় পরিষদ ভবনের দরজায়। কিন্তু সেখানেও নেমে আসে পুলিশি হামলা।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শহরে জারি করা হয় সন্ধ্যা আইন। মেডিকেল হোস্টেলের ২০ নম্বর ব্যারাক থেকে সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে ২২ তারিখ সকাল ৭টায় মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে গায়েবানা জানাজা, পরে সভা ও জঙ্গি মিছিলের কর্মসূচি। ইতিমধ্যে পুলিশ মেডিকেল কলেজ ঘিরে রাখে। গুম করে অনেক অজানা শহিদের লাশ। কিন্তু শহিদের রক্তে তখন লেখা হয়ে গেছে আজ ও আগামীদিনের দৃপ্ত ইতিহাস। প্রতিটি বাঙালির রক্তকণিকায় প্রবাহিত হয়েছে শহিদের রক্তবীজ। এই হচ্ছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস।
সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, সালাহউদ্দীন, জব্বার জন্ম দিয়েছেন আমাদের চেতনা ও সাহস। যার পথ ধরে এসেছে স্বাধীনতা। এসেছে মুক্তি। জন্ম নিয়েছে আমাদের দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ।