রায়হান আহমেদ তপাদার »
কোন দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্টি সমস্যাই বেকার সমস্যা। বর্তমান বাংলাদেশে এই সমস্যা জটিল ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।এমনকি বেকারত্ব যে আমাদের প্রধান সমস্যা তা আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন কর্মসংস্থানের অভাবকে। আমাদের প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে কর্মসংস্থানের বৈপরীত্য রয়েছে। বিগত এক দশক ধরে আমাদের জিডিপি ৬ শতাংশের উপরে এবং বিগত ৩ থেকে ৪ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের উপরে উন্নীত হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। তার উপর করোনার আতঙ্ক প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাড়া করছে। একেকটি দিন পার করা করোনামুক্ত সময়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বে শুধু আক্রান্ত আর মৃত্যুর হারই বাড়ছে না, মানুষের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা ন্ডমকির মুখে পড়ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের পথ। বাড়ছে অর্থসংকট। ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এ মন্দা স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে, তাও বলতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের অন্তত ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী তরুণ কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হিমশিম খেতে হয়। কর্মে সক্ষম নতুন যোগ হওয়াদের মধ্যে অর্ধেক থেকে যায় বেকার। আবার অদক্ষ, অল্প দক্ষদের বড় অংশ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এমন বাস্তবতায় করোনার হানা অনেকটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির জন্য লড়াই করতে হয় লাখ লাখ তরুণকে অনেক শিক্ষিত গ্রাজুয়েটকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। এর মধ্যে প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকেন হাজার হাজার তরুণ।
অপরদিকে নন-ক্যাডার সরকারি ও বেসরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন আরো বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব চাকরির পরীক্ষাই আটকে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে চাকরির পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও শেষ পর্যায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অনেকেই আছেন, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। স্বভাবতই তারাই বেশি উদ্বিগ্ন। বস্তুত করোনা যুব সম্প্রদায়ের হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি। মোট আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে অভাব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব রয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন করে কাজ হারাচ্ছে মানুষ। ফলে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বেকার সদস্যদের সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন বেকারের মিছিল। শুধু তাই নয়, স্থানীয় বেকারের বোঝার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসা লাখ লাখ প্রবাসীর চাপ। করোনা আতঙ্ক এখনও সবাইকে তাড়া করে ফিরছে। শিল্পকারখানা, অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা খোলা হলেও মারাত্মক ন্ডমকির মধ্যে পড়ে আছে শ্রমবাজার। একদিকে জীবন আশঙ্কা, অন্যদিকে জীবিকার তাগিদ। কোন দিকে যাবে মানুষ, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অগণিত মানুষ। এখানেও কাজের তেমন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ফলে এই সময়ে অর্থনীতিতে অবশ্য সব সমস্যা ছাপিয়ে বেকারত্বই প্রকট আকার ধারণ করেছে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে বেকারত্বের সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক সঙ্কটও। ইতিমধ্যে দেশে অগণিত মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে।প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষার বিস্তারের কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাই আমাদের অর্থনীতির চেহারাটা আরও বদলে দিতে পারে। দেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরি নিয়ে যেতে পারে তারা।
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে উপযুক্ত এবং ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পেতে পারে তারা অনায়াসেই। এভাবে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স ধারায় বিপুল জোয়ার সৃষ্টি হতে পারে। বেকারত্ব আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি একটি সমস্যা। এখানে প্রতি বছরই শিক্ষিত ও অশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার তালিকায় উঠে আসছে। দিনে দিনে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে হানা দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। যা দেশে বেকারের সংখ্যা এক লাফে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থানের নতুন কোনো সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছেনা। এরই মধ্যে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী, হকার, শ্রমিক তাদের চাকরি ব্যবসা ইত্যাদি হারিয়ে বাড়িতে কর্মহীন অবস্থায় দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তেমন পরিস্থিতিতে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই সরকারের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রথম কাজ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেহেতু টিকা এসেছে তাতে অবশ্যই করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসবে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও সহজলভ্য হওয়ায় দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে তেমন আশা করছেন কেউ কেউ। করোনা বিশ্বজুড়ে সব ক্ষেত্রে বিরাট একটা ধাক্কা দিয়েছে। এ রকম অনিহুয়তার মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যে শিল্প উদ্যোগে নতুন বিনিয়োগ আসছে কম, বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না। করোনা চলে গেলে অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা এমনিতেই দ্রুত বাড়তে থাকবে। তখন বিনিয়োগও হবে। এর মাধ্যমে নতুন চাকরির সংস্থানও হবে। কিন্তু সেই প্রতিক্ষিত সময়ের জন্য অনির্দিষ্ট সময় ধরে অপেক্ষা না করে কর্মসংস্থানের জন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণটা জরুরি হয়ে উঠছে এই মুহূর্তে। করোনাভাইরাসের কারণে নতুন করে বড় রকমের বিপর্যয় না ঘটলে এই ভীতি দূর হওয়াটা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হয়ে ধরা দিয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকা- ও কর্মসংস্থান আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে এবং নতুন করে কাজের ও ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করতে করোনা নিয়ে ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে। যাতে নতুন করে কোনো মহাবিপর্যয় না ঘটে। এজন্য প্রয়োজন শিগগির কারোনা টিকা গ্রহণ করা। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশ প্রত্যাগত শ্রমিক কর্মীদের আবার তাদের আগের কর্মসংস্থানে ফেরত পাঠাতে নানাভাবে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে তারা হারানো চাকরি ফিরে পায় সেজন্য দেনদরবার শুরু করেছে। আর যারা ফেরত যেতে পারছেনা তাদের স্থানীয়ভাবে কাজের ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে আত্ম কর্মসংস্থানকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে দিন দিন। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। সরকার এ লক্ষ্যে যেসব প্রদক্ষেপ গ্রহণ করছে আর যথাযথ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাই বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে খামখেয়ালি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের কাজগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু সরকারি উদ্যোগ, পদক্ষেপ, ব্যবস্থাপনার দিকে তাকিয়ে না থেকে বেসরকারিভাবে দক্ষতা, মেধা, অভিজ্ঞতা এবং মূলধনের যথোপযুক্ত ব্যবহার সুনিহিুত করতে হবে। সমন্বয়হীনতা এ ধরনের উদ্যোগে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করে। এ বিষয়টিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।জনবন্ডল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী পুরুষ যদি কর্মক্ষম এবং উপার্জনক্ষম হয় তাহলে সে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবে মজবুত হতে বাধ্য। জনশক্তিকে কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এটা দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার সঠিক এবং কার্যকর উপায়। বেকার, কারিগারি জ্ঞানশূন্য তরুণ-তরুণীদের মেধা, শ্রম ও মননশীলতাকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে আরও অনেক দুর্যোগ এসে হানা দিতে পারে। আমরা কোনোভাবেই তা চাই না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল। আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেন তরুণরা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু বর্তমান তরুণ সমাজের বড় অংশই বেকার, অনিহিুত জীবনের পথে। যার কারণে অনেক তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথেও হাঁটেন। আজ তরুণদের বড় একটি অংশ এ দেশের প্রতি মমত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে আগের মতো স্বেচ্ছাশ্রম আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তারুণ্য খুবই কম দেখা যায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছে, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে এক প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে। বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরণ এক নয়। সেখানে সরকারিভাবে বেকারদের ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও সেসব দেশের বেকাররা এ ভাতা নেয়াকে অসম্মানজনক মনে করে।
আবার ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের জনশক্তি কম এবং কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। তারা অন্যদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করে। আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকলেও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ।বলা যায়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ।বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে। জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি করতে হলে সত্যিকারের শিক্ষা নিতে হবে। দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের বিশালতায় উন্মুক্ত করতে হবে নিজেদের। আর আনন্দ মনে তরুণরা এগিয়ে গেলে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স