মোহীত উল আলম »
‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।’ জাতীয় কবির এ পংক্তিটি ঈদ উৎসবের জন্য সর্বকালে প্রযোজ্য। যদিও ঈদ একটি পবিত্র ধর্মীয় পরব, কিন্তু ঈদের উৎসবের আমেজ বরঞ্চ সামাজিক, আর এর বাস্তবায়নটা অর্থনৈতিক। ঈদের মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোয়, ভালোবাসার প্রকাশে, ক্ষমা প্রদর্শনে ও পরার্থপরতায়, যেগুলি অবশ্য ঈদ উৎসব পালনের সময় আমাদের কখনও মনে থাকে না।
ঈদের উৎসবের সঙ্গে চাঁদ দেখার আনন্দও জুড়ে থাকে। আজকাল অবশ্য স্যাটেলাইটের কারণে মানুষ ঘরে বসে টিভিতে চাঁদ দেখার কথা শোনে, কিন্তু ছাদের ওপরে উঠে কিংবা উচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে মানুষ চাঁদ দেখতে আর আগ্রহী থাকে না। ‘চাঁন রাতে’ ঘরে ঘরে পুরুষের চেয়েও মহিলাদের ব্যস্ততা থাকে বেশি। আর শিশুরা তাদের মায়ের ঈদের খাবারের আয়োজন প্রলুব্ধ নয়নে দেখতে দেখতে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে। কবি জসীম উদ্দিনের ‘আমার মা’ শীর্ষক একটি গদ্যলেখায় চান রাতে মায়ের পিঠা বানানোর মনোহর বর্ণনা আছে।
তবে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে দু’টো ব্যাপার ঈদ আনন্দকে মাটি করে দিচ্ছে। একটি হলো, সমাজে ধনী-দরিদ্রদ্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, আরেকটি হচ্ছে ভেজালের মহামারী।
যদিও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলির অগ্রভাগে আছে কিন্তু একটা কথা অর্থনীতিবিদেরা ক্রমশ বলে যাচ্ছেন যে উন্নয়নশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানও বেড়ে যাচ্ছে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, মোট অর্জিত উপার্জনের শতকরা ৯৫ ভাগ নাকি মুষ্টিমেয় ধনপতিদের হাতে চলে যাচ্ছে।
ভেজালের সংস্কৃতি কিন্তু আলাদা কোন দ্বীপের মতো তৈরি হয় না। আঙ্গুলের আগায় একটি ফোঁড়া হয়েছে এটা সেরকম নয়। জন্ডিস হলে যেমন সারা শরীর সেটা বহন করে ভেজাল জিনিষটা সেরকম। এটা সারা শরীরেই পচন ধরায়। মাত্র গতকালই (২ এপ্রিল ২০২৪) দুদক প্রধান মোহাম্মদ মঈন আবদুল্লাহ গণমাধ্যমে বলেছেন যে আগে দুর্নীতিবাজরা রাতের অন্ধকারে কিংবা লজ্জায় রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতো, এখন তারা রাস্তার মাঝখানে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, কারণ দুর্নীতিকে তারা দুর্নীতি মনে করে না। গৌতম বুদ্ধের দর্শনে এ কথাটি স্থান পেয়েছে যে মানুষের দুঃখ আসে লোভ থেকে। ভেজাল হচ্ছে লোভের একটি অনবরুদ্ধ প্রকাশ। ক্ষমতার লোভ, খ্যাতির লোভ, সনদের জন্য লোভ, প্রেমের লোভ, কাম-লোভ, এবং অর্থের প্রতি লোভ হলেই ভেজাল ঢুকবে।
ঈদের ধর্মীয় আবেদন ব্যতিরেকে ঈদের মূল তাৎপর্য অর্থনীতির মূল একটি সূত্রের মধ্যে নিহিত। সেটা হলো, কাট ইয়োর কোট একর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ। যতটুকু প্রয়োজন কাপড় ততটুকুই কিনো। এই কথাটা অবশ্য পুরোনো দিনের, এখন বলা হয়, বাই ইয়োর ক্লথ একর্ডিং টু ইয়োর নিড। নিজের প্রয়োজন মোতাবেক কাপড় কিনো।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন অর্থকড়ি সংক্রান্ত মুরব্বী সংস্থা তাই-ই বলছে। এর একটি বিরাট সূচক হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির উল্লম্ফন। টাকায় এবং সংস্কৃতিতে। বাংলাদেশের দরিদ্র শ্রেণির অবস্থান হিসেবের বাইরে। এদের দারিদ্র কখনও মুছবার নয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভ অর্জন করা শ্রেণি। এই শ্রেণিটি যেমন টাকায় পুষ্ট হয়েছে, তেমনি হয়েছে সংস্কৃতিতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি কারা তার সংজ্ঞায়ন মোটামুটি এরকমভাবে করা যায় যে যাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া আছে, যাদের কিছুটা উচ্চ মেধা আছে, আছে কিছুটা উচ্চাকাংক্ষা, এবং আছে প্রচুর হিংসা, দ্বেষ এবং প্রতিশোধস্পৃহা, এবং যাদের বেশিরভাগই চাকরি-নির্ভর জীবনযাপন করে, এবং যারা যে কোন বিষয়ে যেমন ক্রীড়া, সাহিত্য, ধর্ম, রাষ্ট্র এইসব গুরুতর বিষয়ে মতামত দিতে ওস্তাদ, এবং যারা ফেইসবুকে চাষ করে নানারকমের মতদ্বৈততা, তারাই মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশে এই মধ্যবিত্ত শেণির সংখ্যা প্রায় নয় দশ কোটি। এদের চাওয়া-পাওয়ারই প্রতিফলন হচ্ছে ঈদ বাজার।
আর দরিদ্র শ্রেণির কথা ফলাও করে না-ই বললাম। এদের জন্য ঈদ উদযাপন আর দারিদ্র-উদযাপন প্রায় সমার্থক হয়ে পড়েছে। অসমর্থ পরিবারগুলোতে ঈদ উপলক্ষে যে অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার কিংবা সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে লড়ালড়ি শুরু হয়, তা’তে দিন শেষে গৃহস্বামী বালিশে শান্তিতে মাথা রাখতে পারে কিনা সন্দেহ।
আমার একজন সহকর্মী অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে খুব চিন্তা করেন। বললেন, স্যার, আপনার ধারণা ভুল। বড় লোকেরা যে ঈদে খুব খরচ করে তা নয়। কারণ জীবনযাপনের স্বাচ্ছল্যে যেসব উপকরণের প্রয়োজন তা তারা বহু আগে থেকেই ক্রমশ সংগ্রহ করে ফেলেছে। কাজেই ঈদের সময় তাদেরকে আবার নতুন টার্গেট ঠিক করে খরচ করতে হয় না। হয়ত তারা উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে বিদেশ-টিদেশ সফর করে এই যা। কিন্তু ঈদের সময় খরচ বেড়ে যায় মধ্যবিত্ত এবং গরিবদের। ঈদ হল তাদের জন্য একটা উপলক্ষ্য যখন তারা তাদের অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে খানিকটা শখের জিনিষপত্রও সংগ্রহ করে থাকে। এরাই ঈদের বাজারটা সরগরম রাখে। কথাটা আমার বিশ্বাস হল।
তারপরও পারিবারিক এবং পেশাগত জীবনে ঈদসংশ্লিষ্ট একটি অর্থনৈতিক দর্শন কাজ করে। জাকাত, দান-খয়রাত এসব ছাড়াও আমার মনে হয় অপচয়ের মাত্রাটা বুঝতে পারাও ঈদের সময় একটি প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক শিক্ষা। বস্তুগত জীবনের প্রতি মানুষের লোভ থাকেই, কিন্তু সেটা যদি প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে নিয়ন্ত্রিত রাখা যায়, তা হলে ঈদের অর্থনীতি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয়।
প্রয়োজনটা অবশ্য আপেক্ষিক। এটার কোন সোজাসুজি সংজ্ঞা হতে পারে না। কিন্তু এখানেই লেগে গেল ফ্যাঁকড়া। প্রয়োজনের সংজ্ঞাতো অনির্ধারিত, অর্থাৎ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তফাৎ, অর্থাৎ আপেক্ষিক। কারো কাছে একটি বিছানার চাদর যোগাড় করাটা হচ্ছে প্রয়োজন মেটানো, আবার কারো কাছে একটি এসি লাগানোটাই হচ্ছে এই গরমের দিনে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন। একজন টিভি বা চলচ্চিত্র তারকার অনেকগুলো শার্টের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু একজন অধ্যাপকের কয়েকটা শার্ট হলেই চলে। বারাক ওবামা সম্পর্কে জানলাম, তিনি হোয়াইট হাউজের জীবনে পুরো আট বছরই একই স্যুট—সেই বহুল কালো স্যুটটি—পরেই কাটিয়েছিলেন। ঈদ তাই আমাদেরকে একটি চিরকালীন দ্বন্দ্বের মুখোমুখি করে ফেলে । কত আছে, কত খরচ করা যাবে, অথবা কত ঋণ করতে হবে, এবং ঋণ করে ঘি খেতে হবে।
ডিজিটাল যুগে এসে সামাজিক মানুষ এক ধরনের সমস্যায় পড়েছে। মানুষের সব ধরনের ফ্যাশনের প্রতি এখন চোখ গেছে। বহু ওয়েবসাইট আছে শরীরের সৌন্দর্য কীভাবে বাড়ানো যায়, মেদ কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে নিজেকে আরো সুশ্রী রাখা যায়—এগুলি মডেলের ছবিসহ স্মার্ট ফোনগুলোতে এন্তার আসতে থাকে। ফলে ব্যবহারকারীও প্রলুব্ধ হয়। আগে ঈদকে মনে করা হত শুধু ছোটদের আনন্দোৎসব। কিন্তু হাল আমলে, ডিজিটাল যুগে, রূপ-সচেতনতার মাত্রা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে সব বয়সের নারী-পুরুষ এখন বুঝতে পারছে যার যার রূপের সৌন্দর্যবর্ধন করার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। সেজন্য বিউটি পার্লার বেড়ে গেছে, ব্যায়ামাগার বেড়ে গেছে, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যবিষয়ক চিকিৎসাদিও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পোশাক-আশাকের বহর। আগে বয়স হলে মুখের চামড়া কুঁচকানোকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হত, কিন্তু এখন সৌন্দর্যাগারে আপনাকে বলবে তারা আপনার মুখকে একদম তরতাজা তরুণ-তরুণীর মুখের মতো ফ্রেশ করে দেবে। যা হোক, বৃদ্ধ বয়সেও মুখটাতো একটু মসৃণ হলোই, এইটাইতো ঈদের আনন্দ। পার্লার থেকে বাসায় গেলেন, সবাই মুখের মসৃণতা খেয়াল করলেও আপনার সেই পুরোনো স্ত্রী তা মোটেও খেয়াল করলেন না। আর এটাই হল ঈদের বেদনা।
আসলে ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের জীবনে যে অর্থনৈতিক চাহিদা বেড়ে যায় এটার বাস্তবতা অনস্বীকার্য হলেও, সারা মাসব্যাপী রোজার মধ্যে যে সংযম বা কৃচ্ছতাসাধনের কথা আমাদের ধর্মে বারবার করে বলা হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে ঈদের মধ্যেও একটি শান্ত-সমাহিত ঈদ উযাপনের অবকাশই থাকে। ঈদ ঠিক উচ্চকিত আনন্দ উৎসব নয়, বরঞ্চ ধর্মীয়ভাবে যেটা ব্যক্ত করা হয়েছে ঈদে যেন সবাই শত্রু-মিত্র এক হয়ে মানুষে মানুষে মিলন হয়ে মানবতার জয়গান গাইবে, সে পরিবেশটাই মুখ্য থাকে।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ