সুপ্রভাত ডেস্ক »
বঙ্গবাজারের মাঝামাঝি জায়গার নিচে তলায় ভুঁইয়া ফ্যাশনের মালিক মোশাররফ কামাল ভুঁইয়ার দোকানে ঈদের আগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার পোশাক তোলা হয়েছিল। আগুন লাগার পর ধোঁয়ার কারণে দোকানে ঢুকতে না পারায় একটি পণ্যও বের করা যায়নি, ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে কামাল ভুঁইয়ার জীবিকার সম্বল।
কামালের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া ঘাগরা গ্রামে, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় ম্যানেজার জাহাঙ্গীর ও কয়েকজন স্টাফকে নিয়ে দোকান চালাতেন কামাল। ‘দোকানের ১৫-২০ লাখ টাকার মালামাল শেষ, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
কামাল ভূঁইয়ার মত আরও অনেকে ব্যবসায়ীর দোকান, গুদাম সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে ভয়াবহ এই আগুনে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলাট্রিবিউনের।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস মিনিট দুইয়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেও বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন।
ব্যবসায়ী কামাল বলেন, ভোরে ম্যানেজার তাকে জানায় বঙ্গবাজারের কোনো এক মার্কেটের উপরের কোথাও আগুন লেগেছে, ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। কোনো মালামালই সরাতে পারেনি কর্মচারীরা।
বলতে বলতে ভেঙে পড়েন কামাল। বলেন, ‘অল্প পুঁজি দিয়ে শুরু করা এ দোকান ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল, আগুনে সব শেষ হয়ে গেলরে ভাই।’
তার মতো বঙ্গবাজারে আরও পাঁচ হাজারের মত দোকানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান কামাল।
ঈদ সামনে রেখে বঙ্গবাজার ও আশপাশের মার্কেটের সব দোকানেই প্রচুর নতুন পণ্য তোলা হয়েছিল। কীভাবে সেখানে আগুন লাগল তা এখনও স্পষ্ট নয়। সকালে আগুন লাগার পর ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কাউকে কাউকে মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। অসহায়ভাবে কাঁদছিলেন অনেকে।
বঙ্গবাজারের উল্টো দিকে বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স মার্কেটের ফ্যাশন ওয়্যার হাউজের মালিক মোহাম্মদ শুক্কুর আলী বলেন, ‘মূল বঙ্গবাজারে ছয়টা মার্কেটে ছিল। এখন আর নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
বেলা ১ টার দিকে তিনি জানান, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স ও পাশে আরও তিনটা মার্কেটও অগ্নিকা-ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
‘আমাদের মার্কেটের ছয় তলায় শার্টের কাপড়ের গুডাউন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাশের মার্কেটের নিচ তলায় আমাদের শো রুম। যা ছিল তাও শেষ। এখানে ১২-১৩ লাখ টাকার মালামাল ছিল।’
আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে: এনামুর
বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতি নিরূপণ করে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
তিনি বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যববসায়ীদের ক্ষতি নির্ধারণ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’
মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে বঙ্গবাজারের কয়েকটি মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার চারটি ইউনিটে বিভক্ত। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি।
ঈদ সামনে রেখে প্রতিটি দোকানেই লাখ লাখ টাকার পণ্য তোলা হয়েছিল বিক্রির জন্য। বেশিরভাগ পণ্যই পুড়ে ছাই হয়েছে, দোকানিরা সেসব সরানোর সুযোগ পাননি।
সাড়ে ৬ ঘণ্টার পর বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার মত হতে পারে বলে তার ধারণা।
আর এই ক্ষতি পোষাতে সরকারের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
চার বছরেও সতর্কবার্তা গায়ে মাখেননি বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা : ফায়ার সার্ভিস
‘২০১৯ সালে বঙ্গমার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও তারা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল,’ বলেন বাহিনীর মহাপরিচালক।
ভয়াবহ আগুনে ঢাকার বঙ্গবাজার পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, চার বছর আগেই ঝুঁকির কথা ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছিল। একাধিকবার নোটিস দিলেও তারা সতর্ক হননি।
ঢাকায় কাপড়ের অন্যতম বড় এই বাজারে মঙ্গলবার ভোরে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুটি দল প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
তবে এরই মধ্যে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়। পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগুনে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ভোর থেকেই সেখানে অবস্থান করে বাহিনীর কর্মীদের কাজ তদারকি করছিলেন।
উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে বঙ্গমার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও তারা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। তারা ছাড়াও অন্য কোনো সংস্থা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।’
আগুন কীভাবে লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি এখন বলা সম্ভব নয়। এই ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।’
আগুন নির্বাপনে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, ‘এখানে অনেক বাতাস, যার জন্য অনেক সময় লাগছে।’
ফায়ার সার্ভিস যখন বঙ্গবাজারে প্রাণপাত করে চেষ্টা করছিল, সে সয় বঙ্গবাজারের উল্টো পাশে বাহিনীটির সদরদপ্তরে হামলা করে কিছু মানুষ। এ নিয়েও দুঃখ প্রকাশ করেন মাইন উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা এই ঘটনায় অত্যন্ত দুঃখিত ও মর্মাহত যে এত বড় একটা আগুন এখানে লেগে গেল। আমি মর্মাহত আরেকটি কারণে।
‘ফায়ার সার্ভিস সব সময় জনগণের সেবায় জীবন দেয়। শুধু আমরা আগুন নির্বাপন করি না, জনগণের সেবায় আমরা জীবন দিই। কিন্তু আজকে আমাদের সদরদপ্তরে জনগণ ঢুকে আমার গাড়ি ভাঙচুর করেছে, আমার হেডকোয়ার্টারে নতুন যে ভবন হয়েছে, সেটি ভাঙচুর করেছে। আমি খুবই মর্মাহত, আপনাদের জন্য আমরা জীবন দিই, সেই আপনারা আমাদের ওপর হামলা করলেন।’
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, ‘জনগণের বাধার কারণে আগুন নেভানোর কাজে বিঘœ ঘটেছে। জনগণের হামলা ও আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট আটজন আহত হয়েছে।
‘এর মধ্যে দুইজন দগ্ধ। তাদেরকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক
বঙ্গবাজার অগ্নিকা-ে ফায়ার সার্ভিসকে দুষলেন ব্যবসায়ীরা
বঙ্গবাজার অগ্নিকা-ে ফায়ার সার্ভিসের অবহেলাকে দায়ী করছেন মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, শুরুতে এই অগ্নিকা-কে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তাই দুইটি আগুন নির্বাপক বোতল নিয়ে এসেছিলেন। পরে আগুন বাড়লে মার্কেটের চাইতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষার চেষ্টাই বেশি করেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী হোসাইন বলেন, ‘৬টা বাজে যখন আগুন লাগছে তাগোরে ডাক দিলে তারা বোতল (আগুন নির্বাপক) নিয়া আসছে আগুন নিভাইতে। কিন্তু আগুন নিভে না। তাদের বলছি পানির গাড়ি নিয়া আসেন। তারা বলে ওপর থেকে আমাদের হুকুম আসে নাই। হুকুম আসছে ৭টার পরে। পরে গিয়ে তারা পানি নিয়ে আসছে সেইটারও স্প্রিড নাই। সারা দেশের ফায়ার সার্ভিসের মেইন অফিস এইখানে, আর এইখানে বলে তাদের পাম্পে পানি নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ৮টার দিকে তাদের বলছি পানি বাড়ান। তারা বলে বছরে দুই একবার আগুন লাগবোই, ঈদে আগুন লাগেই।’
সিদ্দিকবাজার ফায়ার সার্ভিসে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি ছিল না মন্তব্য করে আরেক ব্যবসায়ী সুলতান বলেন, ‘বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের হেড অফিস এটা, এইখানে পানি থাকবো না তো কই থাকবো। সকালে তাদের যথেষ্ট পানি ছিল না। পরে ঢাকার অন্যান্য জায়গা থেকে ফায়ার সার্ভিসের লোক এসে আগুন নেভানোর কাজ করছে।’
আগুন লাগার পেছনে ফায়ার সার্ভিসকে সরাসরি দায়ী করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসই লাগাইছে আগুন। তারাই প্রত্যেক সপ্তাহে মহড়া দেয় এই মার্কেটে। আজকে তারা পানি দেয়, পানি আগুন পর্যন্ত পৌঁছায় না। যেইখানে আগুন লাগছে তার উল্টা পাশে ফায়ার সার্ভিস কিন্তু, আগুন নিভলো না, পুরাটা পুইড়া ছাই হইয়া গেছে, বিশ্বাস হয়!’
ফায়ার সার্ভিস সকালে মার্কেট রক্ষার চাইতে পাশে থাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছে মন্তব্য করে আরেক ব্যবসায়ী নাঈম বলেন, ‘শুরুতে এত ঘটনা ঘটতোই না। যখন সকালে আমি আসি তখন ওপরে একটু আগুন ছিল, তখন ঠিক মত পানি দিলে একটা দুইটা দোকান পুড়তো। কিন্তু তারা হাতে কইরা আগুন নিভানোর দুইটা বোতল নিয়া আসছে। পরে যখন আগুন লাগছে তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে পানি দিতাছিল যেন সেই দিকে আগুন না যায়।’
এর আগে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থলের অপরপাশে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এর প্রধান কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন বিক্ষুব্ধরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর এর কর্মকর্তা (মিডিয়া) বলেন, ‘তারা কেন এমন অভিযোগ করছে আমরা জানি না। আগুন নেভাতে আমাদের চেষ্টার কোনও ঘাটতি ছিল না। বরং অগ্নিকা-ের সময় কিছু লোক আমাদের অফিসে ভাংচুর ও হামলা চালিয়েছে।’