ড. মো. কামাল উদ্দিন »
ইসরায়েল তৃতীয়বারের মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক কূটনৈতিক চুক্তিতে পৌঁছেছে গত ১৩ আগস্ট। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাদের দখলকৃত ও দাবিকৃত পশ্চিম তীরের অংশীকরণ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সম্মত হওয়ায় ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তি সম্পাদিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক চুক্তি হিসেবে প্রশংসা করেন।
আসলে কী রয়েছে এই চুক্তিতে? ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিবাদ অন্যান্য আরব দেশের মধ্যে বিবাদের অন্যতম উৎস। এই চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশ প্রথমবারের মতো একটি সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই মুহূর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনও উপসাগরীয় আরব দেশগুলো তেমন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে তাদের সঙ্গে বেসরকারি যোগাযোগ রয়েছে। এই চুক্তিটিকে তৃতীয়বারের মতো বলার পেছনে কারণ হলো ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে একই রকম চুক্তি করে ইসরায়েল। নতুন চুক্তিটি ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে বিনিয়োগ ও পর্যটন, সাংস্কৃতিক এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য ক্ষেত্রসহ সম্ভাব্য আরও চুক্তির পথ উন্মুক্ত করবে। সরাসরি বিমান যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে দুই দেশের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দেশগুলো তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরি করবে এটি স্বাভাবিক। তবে বহুকাল ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এর পেছনে মৌলিক কারণ হলো ইসলাম ও ইহুদিবাদের ঐতিহাসিক মতভেদ, ইসরায়েল কর্তৃক আল আকসা মসজিদ দখল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ওপর ইসরায়েলের অন্যায় হস্তক্ষেপ। তবে হঠাৎ করে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েল চুক্তি সম্পাদন করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি এবং তা আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায়? নাটকীয়ভাবে এই চুক্তির পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত মুসলিম বিশ্বসহ অন্যরা।
ট্রাম্প প্রশাসন কেন এই চুক্তির সঙ্গে জড়িত হলেন বা তাদের স্বার্থ কী তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। হয়তো ইরানকে আরব বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এবং ইসরায়েল প্রজাতন্ত্রের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাবকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর মধ্যে চুক্তির জন্য জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সে বিবেচনায় আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তি ইরানের জন্য বড় দুঃস্বপ্ন। ট্রাম্প, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্সের মধ্যে একটি টেলিফোন কল করে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়েছিল। জ্যারেড কুশনার মধ্যপ্রাচ্য নীতির দায়িত্বে থাকা অন্যতম শীর্ষস্থানীয় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাও এই চুক্তির ঘোষণার জন্য হোয়াইট হাউসে উপস্থিত ছিলেন।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের দীর্ঘকাল ধরে চলমান আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের কারণে উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা থেকে অনেক আগে থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ঘাটতি ও সন্দেহ ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আরব দেশগুলো এই চুক্তির প্রশংসা করলেও ফিলিস্তিনি নেতারা এই চুক্তির তীব্র নিন্দা করেন। তারা আশঙ্কা করেন যে এই চুক্তির ফলে ফিলিস্তিনের ভূমি ইসরায়েলের দখলে যেতে আরও ত্বরান্বিত করবে। এর কিছুটা প্রমাণ মিলে চুক্তির পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে পশ্চিম তীরের জায়গা অংশীকরণ কেবল স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে এই চুক্তিতে, কিন্তু তা বাতিল করা হয়নি। এ বক্তব্য থেকে আশঙ্কা করা যায় যে ভবিষ্যতে পশ্চিম তীরের ভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
অনেকে আবার মনে করেন যে, এই চুক্তির ফলে অন্যান্য আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তির দ্বার উন্মোচিত হলো। আবার অনেক আরব দেশ কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নীরব রয়েছে। বেশ কয়েকটি আরব দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়। ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে চাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ উপসাগরীয় দেশ ওমান সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। চুক্তির পর জর্ডান থেকে আরেকটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী মিশরের পর জর্ডান দ্বিতীয় আরব দেশ এবং এর ৮ মিলিয়নেরও বেশি নাগরিকের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত। জর্ডানের প্রতিক্রিয়ায় বলা হয় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের যে অঞ্চল অধিকারে নিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে তারা যদি সত্যিকার অর্থে তা বন্ধ করে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে ইসরায়েল মেনে নিতে চুক্তি যদি উৎসাহিত করে তা হলে আরব বিশ্ব শান্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারে এই চুক্তির মাধ্যমে। তবে সত্যিকার অর্থে ইসরায়েল দ্বন্ধকে যদি এটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কয়েক দশকের পুরনো আরব-ইসরায়েলি দ্বন্দ্বকে আরও গভীরতর করবে এবং পুরো আরব বিশ্বের নিরাপত্তা আরও হুমকির মধ্যে পড়বে। ইসরায়েলকে অবশ্যই শান্তির সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ফিলিস্তিনের অধিকার লঙ্ঘন করেÑএই ধরনের কার্যক্রম থেকে ফিরে আসতে হবে।
ইসরায়েল অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনের ভূমি দখলে ব্যস্ত রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকার অস্বীকার করে আসছে। আর তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আরব বিশ্বের জন্য কখনও এই চুক্তি শান্তি বা সুরক্ষা আনতে পারবে না। আর ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনের অধিকার অস্বীকার অব্যাহত রাখে, তাহলে এই চুক্তি অবশ্যই অনুসরণ করা উচিত নয়।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, এ সরকারগুলোর বেশিরভাগই এখনও চুক্তির ফল দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। অনেক আরব দেশ দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি দৃঢ় সহানুভূতি দেখিয়ে এসেছিল, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের রুটি-মাখনের লোভে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সুদানের সার্বভৌম কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে একটি বৈঠককে ইসরায়েল ও সুদানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া শুরুর ইঙ্গিত হিসাবে দেখা হয়। বুরহান ও নেতানিয়াহুর মধ্যে ৩ ফেব্রুয়ারি বৈঠকের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইঙ্গিত করেছে যে ইসরায়েলি ও সুদানি কর্মকর্তারা দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সহযোগিতা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন।
অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তি রিয়াদের সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার গতি ধীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কারও কারও মতে সৌদি আরবের আশীর্বাদ ছাড়া এই চুক্তি সম্ভব হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তি ঘোষণার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কুশনার উল্লেখ করেছিলেন, আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে অন্য একটি দেশ চুক্তি করার পক্ষে একটি ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক কুশনারের এই ইঙ্গিত সৌদি আরবের দিকে বলে অভিমত দেন। এক মার্কিন কর্মকর্তা চুক্তির পর বলেছিলেন যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আগে বাহরাইন ও ওমানের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যান-ইয়ভেস লেড্রিয়ান বলেছেন, ফ্রান্স এই চুক্তির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই চুক্তি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার পথ সুগম করবে। তিনি এ অঞ্চলে শান্তি অর্জনে এটিকে একমাত্র বিকল্প বলে অভিহিত করেছেন। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাশ এ চুক্তি এবং ইসরায়েল কর্তৃক পশ্চিমতীরের অঞ্চলগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্তি স্থগিত সিদ্ধান্ত উভয়কেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। মাশ এক বিবৃতিতে বলেছেন, যে কেবল আলোচনার মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি বয়ে আনতে পারে। চীনও বলেছে যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা লাঘব করতে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে যেকোনও পদক্ষেপকে তারা স্বাগত জানাবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, বেইজিং সব সময় ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার পুনরুদ্ধার এবং তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেকোনও পদক্ষেপকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
ফিলিস্তিনের জনগণ আমিরাতের সিদ্ধান্ত পছন্দ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল সুবিধা ভোগ করবে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের নাগরিক অধিকার নষ্ট হবে। এটি সত্যও হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রত্যেক রাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দেবে এটিই স্বাভাবিক। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের নিজেদের স্বার্থে এই চুক্তি করেছে। ফিলিস্তিনের স্বার্থ তাদের কাছে গৌণ। মনে করা হচ্ছে যে আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হলে পুরো অঞ্চলজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি ও পানির ব্যবহার এবং সাইবার সুরক্ষাসহ বিস্তৃত প্রয়োজনে ইসরায়েলিদের সঙ্গে কাজ করার সুবিধা অর্জনের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু এই চুক্তির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের এও মনে রাখা উচিত যে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলো যদি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয় এবং তাতে তারা সাড়া না দেয় তবে আরব নেতারা তাদের স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে এগিয়ে যাবে। আর ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে যদি ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় তাহলে এটি হবে একটি অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক পদক্ষেপ।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়