হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান »
আজ ১২ মার্চ, ২০২২ তারিখে আমার মাতা মরহুমা ডা. নুরুন নাহার জহুর এর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার মা মরহুমা ডা. নুরুন নাহার জহুর ১৯৩২ সালের ১২ ডিসেম্বর বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুনে আমার নানার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু ও শৈশবকাল কেটেছে রেঙ্গুনে। তিনি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাসটিকাস স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৯ সালে গুলএজার বেগম হাইস্কুল হতে মেট্রিক পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে এল.এম.এফ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত ফ্যামেলি প্ল্যানিং বিভাগে চট্টগ্রাম জিলার মেডিকেল অফিসার হিসাবে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি, সমাজসেবা, সাহিত্যের বিভিন্ন কর্মকা-ে আমৃত্যু সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৯ সালে যখন চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়ন করছিলেন। ১৯৫০ সালে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৫০ সাল হতে ১৯৮৬ সাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ভাবে কাজ করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের কার্যকরী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ভাষার দাবিতে মিছিল পরিচালনা করেন।
তিনি তখন তমদ্দুন মজলিশের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, পরবর্তীতে ১১ দফা এবং ৬৯ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সক্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামীলীগের পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং কাজ করেন। তিনি ১৯৭৫-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য (আমৃত্যু) ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে গেছেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কাজ করার সময় আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে পরিচয় এবং পরবর্তী ১৯৫৫ সালে বিবাহ হয়। ৬০ দশকে ৬ দফা, ১১ দফা, আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনÑটানা ১৯৬০ সাল হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত আন্দোলন সংগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং চট্টগ্রামের মহিলাদের নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামে মহিলাদের সংগঠিত করেন আগ্রাবাদ এবং ও.আর. নিজাম রোডে মহিলাদের যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করেন। ২ মার্চ বিকাল তিনটায় ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিশাল সমাবেশে চট্টগ্রামের মহিলাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১:৩০ মি. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দামপাড়া বাসায় ৮০৭৮৫ টেলিফোন এ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানোর জন্য ফোন করেন। তখন আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী চট্টেশ্বরী সড়কের মেডিকেল হোস্টেল এর বিপরীতে পাহাড়ের উপর ওয়াপদা রেস্ট হাউজে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। আমার মা টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ডিকটেশন দেন এবং আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর নিজের হাতে লিখে নেন এবং তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাটি কয়েক কপি লিখে নেন। এক কপি আমার বাবার নিকট প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের জন্য বাংলা অনুবাদ করে তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালিন নেতাকর্মীদের প্রেরণ করেন।
আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ সালে আজান পত্রিকার মুকুল মেলার সদস্যা ছিলেন। এরপর মুকুল ফৌজ এর সদস্যা ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে এই সংগঠনে কাজ করেছেন। ১৯৫১ সালে আমাদের মাহফিল, চাঁদের হাট সংগঠন পরিচালনা করছেন। ১৯৪৯ সালে লিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপোয়া) বর্তমান মহিলা সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সদস্যা হন। ১৯৫৭ সালে সমাজ কল্যাণ ও স্বাস্থ্য সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২ সালে মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ বা বাওয়া স্কুল)। এই স্কুলটির জমিতে আমার বাবা লীজ নিয়ে চাষাবাদ করতেন এবং আমার মা বাবার অনুমতি নিয়ে ঐ জমিতে ১৯৫৭ সালে প্রথমে মহিলাদের জন্য একটি সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেন এবং পরবর্তীতে লিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপোয়া) অফিস স্থাপন এবং ১৯৬২ সালে আপোয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
ধীরে ধীরে এই স্কুল সুনামের সাথে এগিয়ে যেতে থাকে লিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির (আপোয়ার) তত্ত্বাবধানে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা অগ্রগতি এবং জমি সবই আপোয়া অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দেওয়া। আমার মা ডা. নুরুন নাহার আমৃত্যু এই সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭২ সালে সভানেত্রী এবং পরবর্তীতে সহ-সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
শৈশব থেকে আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর সাহিত্য চর্চায় সক্রিয় ছিলেন। লেখালেখি, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সমাজসেবার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ সালে আমার মায়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা কমরেড কল্পনা দত্ত এবং তার বোন রমলা দত্ত ছিলেন আমার মায়ের ক্লাস টিচার। তাঁদের সান্নিধ্যে আমার মা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং চট্টলার ইতিহাস তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জেনেছেন। আমার মা ছিলেন বইপ্রেমী। আমৃত্যু প্রতিদিন সকালে কোরআন শরীফ তেলওয়াত দিয়ে শুরু করতেন এবং দৈনিক পত্রিকা পড়ার পর বইপড়া ও লেখালেখি শুরু করতেন। আমার মা ঐতিহাসিক “বেগম পত্রিকার” নিয়মিত লেখক ছিলেন। শুধু বেগম পত্রিকা নয় তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে আমৃত্যু ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বেগম, সত্যবার্তা, কাফেলা, ইত্তেফাক, আজাদী, কোহিনুর, সৈনিক, হেরেম, আমান, পূরবী প্রভৃতি পত্রিকা সংকলন ও মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
১৯৪৯ সালে আমার মা যশোর সাহিত্য সংঘ কর্তৃক প্রদত্ত “সাহিত্য রতœ” উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত নিজ সম্পাদনা ও উদ্যোগে ২১ শের সংকলন “রক্তরাঙ্গা ফাল্গুন” সংকলন প্রকাশিত করেন। ১৯৭২ সালে লেখিকা সংঘ ঢাকার কার্যকরী সংসদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ এ ঢাকার “মেঘদূত” সাংস্কৃতিক সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সাল হতে ১৯৮৬ সাল থেকে আমৃত্যু চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুজিব নগর স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন এবং আগরতলা জিবি হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আমার বাবার বি.এল.এফ অফিসের কাজকর্মে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতেন। স্বাধীনতা উত্তর নির্যাতিত অসহায় নারীদের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস হতে কাজ শুরু করেন।
১৯৭২ সালে আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রী হওয়ার কারণে সর্বপ্রথম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে কাজ শুরুর প্রথম দিন আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুরকে তাঁর চাকুরি হতে অব্যাহতি প্রদান করেন। যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমার মায়ের চাকুরিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে কথা বিবেচনা করে আমার বাবা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও, আমার বাবার সাথে বিবাহ হওয়ার পর, একটি সাধারণ দরিদ্র পরিবারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক পরিবারের হাল ধরেছিলেন। আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী ছিলেন একজন অতি সাধারণ মানুষ, জীবনে কখনো লোভ লালসা বা প্রাপ্তির দিকে দেখেন নাই। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও উনার মৃত্যুর পর আমাদের ভবিষ্যৎ এর জন্য ন্যূনতম জীবন ধারণের চাহিদা পূরণের জন্য কিছু রেখে যাননি।
আজকের রাজনৈতিক নেতাদের জীবন যাপনের চিত্র দেখে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিভাবে একজন রাজনৈতিক নেতা বিলাসী জীবন যাপন করেন! দামী গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি, বিলাসী সামগ্রী ব্যবহার করেন। ব্যাংকের জমানো টাকা বা সম্পদের কথা নাই বা বললাম। আমার বাবার সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে যে সকল রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনে দীর্ঘ সময় ত্যাগ ও তিতিক্ষা করে, আমাদের স্বাধীনতা, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা একটি জাতীয় সঙ্গীত উপহার দিয়েছেন, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সে সকল রাজনীতিবিদদের। সর্বশেষ আমার মায়ের এবং বাবার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক : মরহুমার সন্তান ও রাজনীতিক