সুপ্রভাত ডেস্ক
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক রুপান্তর এবং ২০৪১ সাল নাগাদ পল্লীবাসীর জীবনমান উন্নয়নে এটা হবে এক মহাপরিকল্পনার শুরু। এজন্য নির্বাচিত ১৫টি গ্রামে পাইপের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ, আবাসন সুবিধা ও কমিউনিটি স্পেস-সহ শহরের সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে দিয়েই শুরু হতে চলেছে সরকারের ফ্ল্যাগশিপ উদ্যোগ ‘আমার গ্রাম আমার শহর’।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অনেক মাস ধরে সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের পর এই পাইলট প্রকল্প তৈরি করেছে। আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে বলে জানান পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর আগামী তিন বছরে প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পটি একটি মহাপরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়ন করবে। এই মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের নানান সুবিধাসহ সারাদেশের গ্রামগুলোতে গ্রোথ সেন্টার সম্প্রসারিত হবে। খবর টিবিএস।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য এ কে এম ফজলুল হক বলেন, ‘প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হলে প্রতিটি গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়বে। কারণ ২০৪১ সালের উন্নত দেশ হতে হলে গ্রাম-কেন্দ্রিক উন্নয়ন করতে হবে।’
তিনি আরো জানান, এই প্রকল্পের উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হবে। এতে যে দিকনির্দেশনা থাকবে তার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।
পাইলট প্রকল্প
প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, ১৫টি গ্রামের জন্য মোট ৬১৬ ইউনিটের আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। একইসঙ্গে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, পুকুর খননের কাজ থাকবে এই উন্নয়ন পরিকল্পনায়। প্রকল্পের আওতায় পাইলট গ্রামে সড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। এজন্য মোট ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরো গতিশীল করতে পাইলট গ্রামে মোট ২৩টি গ্রামীণ হাটবাজার, গ্রোথ সেন্টার এবং কৃষি পণ্য কলেকশন সেন্টার নির্মাণ করা হবে।
বিশুদ্ধ পানির জন্য পাইপে পানি সরবরাহ, মিনি পাইপড পানি সরবরাহ এবং সাবমারসিবল-টিউবওয়েল স্থাপন করা হবে। এছাড়া রিং ওয়েল স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা, পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন, পুকুর খনন করা হবে।
পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থাপর উন্নয়নে টুইন পিট ল্যাট্রিন স্থাপন এবং সিঙ্গেল পিট ল্যাট্রিনকে টুইন পিটে রূপান্তর করা হবে।
প্রতিটি পাইলট গ্রাম ও তার বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে তোলা হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট। এই পরিকল্পনায় আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- বহুমুখী ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন, খেলার মাঠ উন্নয়ন, জলধার ও নদীর পাড়ে রাস্তা-কেন্দ্রিক সবুজ প্রাঙ্গণ তৈরি, ঈদগাহ, শ্মশানঘাট, কররস্থান উন্নয়ন।
পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য ৫৩ হাজার ‘বন্ধু চুলা’ সরবরাহ করা হবে গ্রামবাসীকে। থাকবে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং সড়ক বাতি।
এছাড়াও পাইলট গ্রামগুলো যেসব উপজেলায় পড়েছে, সেসব উপজেলার জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
যেসব গ্রামে হবে পাইলট প্রকল্প
পরীক্ষমূলকভাবে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশের আট বিভাগের আটটি উপজেলার আটটি গ্রামকে চিহ্নিত করা করা হয়েছে। এছাড়া হাওর, চর, পার্বত্য জেলা, উপকূল, বরেন্দ্র, বিল এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল-সংলগ্ন অন্য ৭টি গ্রামকে বাছাই করা হয়েছে।
এই গ্রামগুলো হলো – গোপালগঞ্জের বিলচান্দা, নরসিংদীর হফিজপুর, নেত্রকোণার ডেমুরা, কুমিল্লার শেকচাইল, চট্টগ্রামের চরশরত, রাঙ্গামাটির ছোট হরিণা, সিলেটের বাগাইয়া, সুনামগঞ্জের শিমুলবাঁক, নওগাঁর খোরদো চম্পা, রাজশাহীর সোনডাঙ্গা, কুড়িগ্রামের পাথরডুবি, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাতক্ষীরার দাতিনাখালী, খুলনার টিপনা এবং বরিশালের ইন্দুরিয়া।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে না। একারণে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গ্রামে শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই হবে না। গ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও জোরদার করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে হবে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কৃষিকে আরো আধুনিকায়ন করা, কৃষি প্রযুক্তি নিয়ে আসতে হবে। এটা করা হলে গ্রামে কর্মসংস্থান হবে। তাহলে যে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো ফলপ্রসু হবে।
তিনি আরো বলেন, যদি কাজের ক্ষেত্র বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকে, তাহলে গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। তাই যাদের জন্য গ্রামে শহরের সুবিধা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
নির্বাচন প্রক্রিয়া
টানা দুই বছর নিবিড় সমীক্ষার পর প্রকল্প প্রস্তাবনার খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করা হয়। এলজিইজির কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালে টেকসইভাবে দেশের গ্রামগুলোতে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প নেওয়া হয়। কারিগরি সহায়তার প্রকল্পের আওতায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ সম্পর্কিত আটটি বিষয়ে সমীক্ষা করেছে। সমীক্ষাগুলো হলো- গ্রামীণ যোগাযোগ, গ্রোথ সেন্টার ও হাটবাজার, গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি স্পেস ও বিনোদন ব্যবস্থা, গ্রামীণ আবাসন, উপজেলা মাস্টার প্ল্যান এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি।
কর্মকর্তারা জানান, এই আটটি বিষয়, একটি অন্যটির পরিপূরক। যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গ্রামীণ হাট-বাজার, গ্রামীণ গৃহায়ন উপজেলা মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
একইভাবে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন – বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সব বিষয়কে নিশ্চিত করতে পারে। প্রতিটি গ্রামে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ মহাপরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে যুক্ত করা হবে।